Advertisement
২০ মে ২০২৪
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

ছাত্রীদের ভিন্ন ক্যান্টিন, মিলল না জুতসই যুক্তি

পড়া-ঘোরা একসঙ্গে, কিন্তু খাওয়ার বেলায় হাঁড়ি আলাদা। এমনই সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে তৈরি হয়েছে নতুন একটি ক্যান্টিন— শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য। প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা পড়ুয়াদের মধ্যে এমন ভেদরেখা টানার যৌক্তিকতা কোথায়?

ছাত্রীদের জন্য তৈরি সেই ক্যান্টিনে উপাচার্য সুগত মারজিত। — স্বাতী চক্রবর্তী

ছাত্রীদের জন্য তৈরি সেই ক্যান্টিনে উপাচার্য সুগত মারজিত। — স্বাতী চক্রবর্তী

সুপ্রিয় তরফদার
শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৬ ০০:৩৪
Share: Save:

পড়া-ঘোরা একসঙ্গে, কিন্তু খাওয়ার বেলায় হাঁড়ি আলাদা। এমনই সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে তৈরি হয়েছে নতুন একটি ক্যান্টিন— শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য।

প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা পড়ুয়াদের মধ্যে এমন ভেদরেখা টানার যৌক্তিকতা কোথায়?

বহু বছর আগে নারী পুরুষের মধ্যে এক অদৃশ্য প্রাচীর গড়ে দিয়েছিল সমাজ। ১৯ শতকে নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা দীর্ঘ বন্ধুর পথ পেরিয়ে ক্লাসরুমে প্রবেশাধিকার দিয়েছিল নারীকে। তবে পুরুষের সঙ্গে শিক্ষার সমানাধিকার পেলেও ‘নীতি-অভিভাবকত্বের’ উপস্থিতিতে সহজ ভাবে মেলামেশা সম্ভবপর হয়নি দীর্ঘ দিন। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী আর পুরুষের বসার ব্যবস্থা ছিল আলাদা। অধ্যাপকদের সঙ্গে মহিলা ছাত্রীরা ক্লাসে ঢুকতেন এবং ক্লাস শেষে তাঁরই সঙ্গে বেরিয়ে যেতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে মানসিকতা, বদলেছে পরিস্থিতি।

বালিকা বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে কো-এডুকেশন বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে হুহু করে। পরের স্তর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ক্লাসরুমের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্ম মুক্ত চিন্তার ঝড় তোলেন ক্যান্টিনে-টেবিলে। তারই মূলে মোক্ষম কুঠারাঘাত!

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি উদ্বোধন হয়েছে একটি ক্যান্টিনের। যেটি মেয়েদের জন্যে ‘সংরক্ষিত’। কিন্তু কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপ না-পসন্দ খোদ ছাত্রীদেরই একটা বড় অংশের। তাঁদের প্রশ্ন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে কী ভাবে এই লিঙ্গ-বিভাজনের মানসিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া হল?

উপাচার্য সুগত মারজিত বলেন, ‘‘আমার কাছে ওই ক্যান্টিনটিকে শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য করার প্রস্তাব এসেছিল। তাই করা হয়েছে।’’ তিনি জানান, সেই প্রস্তাব এসেছিল খোদ ছাত্র সংসদের কাছ থেকেই! কিন্তু কেন মেয়েদের জন্য পৃথক ক্যান্টিনের প্রস্তাব দেওয়া হল? এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সৌরভ অধিকারী শুধু বলেন, ‘‘ওই জায়গায় আগেও একটি মেয়েদের ক্যান্টিন ছিল। আমরা সেটাকে সংস্কার করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম মাত্র।’’ এত বছর অব্যবহৃত থেকে যে ক্যান্টিন দেখিয়ে দিয়েছে মেয়েদের জন্য আলাদা ক্যান্টিন অপ্রাসঙ্গিক, সেটাকেই হঠাৎ নতুন করে গড়ে তোলার প্রয়োজন কেন হল? সদুত্তর মেলেনি ছাত্র সংসদের কাছে।

উল্টে মাস কমিউনিকেশনের এক ছাত্রী সোজাসাপ্টা বললেন, ‘‘নীতি-পুলিশের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্র সংসদ কি আমাদের পায়ে বেড়ি পড়াতে চাইছে? মেয়েদের জন্য আলাদা ক্যান্টিনের কোনও প্রয়োজন নেই।’’ অন্য এক ছাত্রী বলেন, ‘‘ক্যান্টিনে কোনও ছাত্রী নিরাপত্তাহীন বোধ করেন না। তা হলে এটা তৈরির মানে কী?’’ লাইব্রেরি সায়েন্সের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী বলেন, ‘‘এই মানসিকতা বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও পিছিয়ে দেবে।’’

যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তা বলেন, ‘‘পুরোটার ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। ছাত্র সংসদের তরফে যে প্রস্তাব এসেছিল তাতে সায় দেওয়া হয়েছে মাত্র। কারও পায়ে বেড়ি পড়ানোর কোনও উদ্দেশ্য নেই। যাঁর ইচ্ছা হবে না তিনি ওই ক্যান্টিনে যাবেন না।’’

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট প্রাক্তনী ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য মালবিকা সরকার বলেন, ‘‘ছাত্র সংসদের তরফে প্রস্তাব দিয়ে থাকলে কিছু বলার নেই। কিন্তু আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এ ভাবে বিভেদ করার কোনও প্রয়োজন নেই।’’

লেখিকা তিলোত্তমা মজুমদার বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা পড়ান এবং যাঁরা পড়াশোনা করেন, আমরা ধরেই নিই তাঁদের মানসিকতা প্রগতিশীল। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছেলেমেয়েরা খোলাখুলি আড্ডা দেবে, চা-খাবার খাবে, এটাই স্বাভাবিক। এর জন্য আলাদা ঘেরাটোপের কোনও প্রয়োজন নেই। এ ভাবে আলাদা ক্যান্টিন তৈরি করা নিরর্থক, রক্ষণশীলতার পরিচয়। এটা পরিষ্কার বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়াটা নষ্ট করে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টাও হতে পারে।’’

নয়ের দশকে ছাত্রীদের পোশাক বিধি নিয়ে ফতোয়া জারি করে বিতর্ক তৈরি করেছিলেন আশুতোষ কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ শুভঙ্কর চক্রবর্তী। সে দিনের অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রি সরে গিয়ে বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য শুভঙ্করবাবু বলেন, ‘‘ক্যান্টিন এমন একটি জায়গা যেখানে ছাত্রছাত্রীরা খাবারের পাশাপাশি ভাগ করে নেয় মতামত। কর্তৃপক্ষ সেই জায়গা কেন স্তব্ধ করতে চাইছেন, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।’’

সমাজতাত্ত্বিক অভিজিৎ মিত্র বলেন, ‘‘যদি ছেলেদের প্রবেশাধিকার থাকত তবে এটা ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটা বাড়তি জায়গার ব্যবস্থা হত। কিন্তু যদি প্রবেশাধিকার না থাকে তা হলে তা স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।’’

অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় মেয়েদের জন্য আলাদা ক্যান্টিন এবং তাতে ছেলেদের প্রবেশাধিকার না থাকাকে মানসিকতার পশ্চাদাপসারণ বলেই মনে করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এ যুগে দাঁড়িয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত। কর্তৃপক্ষ যদি নিরাপত্তার যুক্তিতে এটা করেন, তার মানে তো তাঁরাই দেখিয়ে দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের নিরাপত্তার হাল কী।’’

অথচ নতুন এই ক্যান্টিনের ঠিক উল্টো দিকেই রয়েছে বহু পুরনো রাখালদার ক্যান্টিন। ছাত্রছাত্রীদের একাংশের দাবি, কর্তৃপক্ষ তো এই চালু ক্যান্টিনটিরও সংস্কার করতে পারতেন। ২০০৭-এ রাখালদার মৃত্যুর পরে সেখানকার সাত কর্মচারীর উপরে দায়িত্ব বর্তায় প্রবাদপ্রতিম ওই ক্যান্টিনের। এক কর্মচারী বলেন, ‘‘আমাদের স্থায়ী কর্মী করে নিতে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলাম। মার্চে সুপ্রিম কোর্ট আমাদের আবেদন মঞ্জুর করেছে। তবে তা এখনও কার্যকর হয়নি।’’ উপাচার্য অবশ্য সাফ বলে দেন, ‘‘এ নিয়ে সব নথি সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি একাধিক ক্যান্টিন থাকে তাতে অসুবিধা কোথায়। প্রতিযোগিতা তো ভালই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

University Canteen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE