Advertisement
E-Paper

চাঁদমারির বন্দুকই নেই, নিশানাবাজের কী কাজ

বিস্ফোরণের শব্দে চমকে বিছানা ছেড়ে উঠে হোটেলের ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিলেন ডক্টর বর্মা। জানলার পর্দা সরিয়ে চোখ রাখলেন বাইরে। ভুলে গেলেন যে, পুলিশ পইপই করে আলো জ্বালতে বারণ করে গিয়েছে।

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৪

বিস্ফোরণের শব্দে চমকে বিছানা ছেড়ে উঠে হোটেলের ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিলেন ডক্টর বর্মা। জানলার পর্দা সরিয়ে চোখ রাখলেন বাইরে। ভুলে গেলেন যে, পুলিশ পইপই করে আলো জ্বালতে বারণ করে গিয়েছে।

ভুলের খেসারতও দিলেন। উল্টো দিকের বহুতলের ছাদে এমন সুযোগেরই অপেক্ষায় ওত পেতে ছিল ডেভিড। তার স্নাইপার রাইফেলের বুলেট নির্ভুল লক্ষ্যে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিল ডাক্তারের বুক।

‘আখরি রাস্তা’ ছবির ডেভিডের (অমিতাভ বচ্চন) মতো পাকা নিশানাবাজেরা বাস্তবেও আছেন। যাঁদের বলা হয় স্নাইপার। প্রতিপক্ষের নাগালের বাইরে থেকে লক্ষ্যভেদ করতে ওঁদের জুড়ি নেই। যে কারণে যুদ্ধ বা সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রতি পদে বিশ্ব জুড়ে তাঁদের কদর বহু দিন ধরে। পঞ্জাবের গুরদাসপুরে সাম্প্রতিক আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে নয়াদিল্লিও রাজ্যগুলোকে বলেছে স্নাইপার তৈরি রাখতে। ঘটনা হল, কলকাতা পুলিশে স্নাইপারেরা রয়েছেন। তবে কার্যত ঠুঁটো হয়ে। কারণ বিশেষ যে অস্ত্রের বলে ওঁরা বলীয়ান, সেই স্নাইপার রাইফেলই নেই লালবাজারের হাতে!

গত ২৭ জুলাই গুরদাসপুরের দীননগরে সন্দেহভাজন লস্কর-ই-তইবা জঙ্গিদের হামলায় চার পুলিশ-সহ সাত জনের প্রাণ যায়, জখম হন ১৯ জন। এগারো ঘণ্টার লড়াইয়ে তিন জঙ্গিও মারা পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রাজ্যগুলোকে হুঁশিয়ারি-বার্তা পাঠিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘এই জাতীয় উগ্রপন্থী আক্রমণ মোকাবিলায় স্নাইপার নামালে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে।’

বস্তুত মন্ত্রকের সহ-অধিকর্তা সঞ্জয় কুমারের বার্তায় স্পষ্ট ইঙ্গিত, মুম্বইয়ে ২৬/১১-র পরে সম্ভাব্য জঙ্গি হামলার মোকাবিলায় প্রত্যাশিত প্রস্তুতিতে কিছু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। যা পূরণের লক্ষ্যে দিল্লি কিছু পরামর্শ দিয়েছে। বার্তা লালবাজারেও পৌঁছেছে। যার সুবাদে প্রকট হয়ে গিয়েছে ঘাটতির বহর। কী রকম?

লালবাজারের এক কর্তা বলেন, ‘‘কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপ (এসওজি) ও কমান্ডোবাহিনীতে পাঁচ-ছ’জন নিখুঁত নিশানাবাজ আছেন। অথচ স্নাইপার রাইফেল একটাও নেই!’’ তিনি জানিয়েছেন, বছর তিনেক আগে ছ’টি রাইফেল চাওয়া হয়েছিল। একটাও মেলেনি। স্নাইপারের কাজ চালানোর মতো একটা আগ্নেয়াস্ত্র বছর দুই আগে হাতে এলেও পুরোদস্তুর ‘স্নাইপার রাইফেল’ বলতে যা বোঝায়, তা এখনও কলকাতা পুলিশের অধরা।

এমতাবস্থায় নিরাপত্তার নানা ক্ষেত্রে লালবাজারকে হোঁচট খেতে হচ্ছে। যেমন ২৬/১১-র ঠিক পরে, ২০০৯-এর জানুয়ারিতে রেড রোডে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের সময়ে সেনাবাহিনীকেই স্নাইপার মোতায়েন করতে হয়েছিল।

তবে লালবাজারের কর্তাদের দাবি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অন্য পরামর্শগুলো মেনে চলা হচ্ছে। যেমন, আত্মঘাতী হামলা প্রতিরোধে আধুনিক হাতিয়ার-সরঞ্জামে সুসজ্জিত ও বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত বাহিনী গড়তে বলেছিল দিল্লি। সেই মতো বছর চারেক আগে কলকাতা পুলিশে তৈরি হয়েছে এসওজি (সদস্য অন্তত ৭০)। রয়েছে শতাধিক সদস্যের কমান্ডোবাহিনী। দুয়েরই মূল হাতিয়ার একে-৪৭, একে-৫৬র মতো স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। আর শহর জুড়ে নজরদারি চালায় যারা, সেই কমব্যাট ফোর্সের (সদস্য প্রায় সাড়ে ছ’শো) অস্ত্র মূলত ইনস্যাস।

এ সবে অবশ্য স্নাইপারের অভাব মিটছে না। এক কমান্ডো অফিসারের বক্তব্য, অটোম্যাটিক বন্দুক দিয়ে নিমেষে প্রচুর গুলিবৃষ্টি করা গেলেও স্নাইপারের কাজ অসম্ভব। ‘‘স্নাইপার রাইফেলের পাল্লা বেশি। নিখুঁত লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম। লুকিয়ে থাকা জঙ্গিদের নিকেশ করতে কিংবা পণবন্দি উদ্ধার অভিযানে স্নাইপার খুবই কার্যকর।’’— মন্তব্য তাঁর।

গুরদাসপুরেও সে দিন স্নাইপার নামানো হয়েছিল। কিন্তু ইজরায়েলি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পঞ্জাব পুলিশের বিশেষ বাহিনীর লোকজন বুলেটরোধী ভেস্ট-হেলমেট না পরায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। কারণ, সেখানে মাথায় গুলি বিঁধে খোদ এসপি বলজিৎ সিংহকে মরতে হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য, ২৬/১১-য় হেমন্ত করকরে, অশোক কামটে, বিজয় সালাসকরের মতো মুম্বইয়ের পুলিশকর্তারাও উপযুক্ত হেলমেট বা ভেস্ট পরেননি। যা শেষ পর্যন্ত তাঁদের মৃত্যু ডেকে আনে।

দিল্লির কড়া বার্তা, এমন ‘গাফিলতি’র যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। লালবাজারের অবশ্য দাবি, তাদের বিশেষ বাহিনী শারীরিক-মানসিক ভাবে যথেষ্ট দক্ষ, এবং হামলা মোকাবিলায় একশো ভাগ তৈরি। ‘‘গোয়েন্দা-তথ্যের ভিত্তিতে এখানে নিয়মিত ট্রেনিং ও রিহার্সাল হয়। ভেস্ট-হেলমেট না-পরার মতো ভুল হবে না।’’— প্রত্যয়ী ঘোষণা এক আধিকারিকের। মহড়া হিসেবে কলকাতা পুলিশের এসওজি, কমান্ডোদের জঙ্গলমহলে মাওবাদী দমন অভিযানেও নামানো হয়েছিল বলে তিনি জানিয়েছেন।

কিন্তু স্নাইপার রাইফেলের মতো অতি প্রয়োজনীয় অস্ত্রই যেখানে নেই, সেখানে ‘পুরোপুরি তৈরি’ থাকার দাবি কতটা যুক্তিসঙ্গত? পুলিশমহলেও প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে। যার কোনও উত্তর কর্তৃপক্ষের কাছে মজুত নেই।

maoist sliper rifle kolkata police
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy