Advertisement
১৯ মে ২০২৪

গাঁধী জয়ন্তীতেও ফোনে শুভেচ্ছার বন্যা

বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই গায়ে জ্বর আসছে, কারণ সামনে পুজো। দেবীপক্ষের আগে ‘হ্যাপি মহালয়া’ থেকে শুরু করে প্রতিটা দিন ধরে ধরে হ্যাপি তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী থেকে বিজয়া দশমী— খুশি বিলোনোয় বিরাম নেই। বারো মাসে তেরো পার্বণ, কথাটা তো বস্তাপচা। দেশি-বিদেশি পার্বণের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।

পায়ে পায়ে: মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর ১৫০তম জন্মদিবসে শোভাযাত্রা। মঙ্গলবার, ধর্মতলায়। নিজস্ব চিত্র

পায়ে পায়ে: মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর ১৫০তম জন্মদিবসে শোভাযাত্রা। মঙ্গলবার, ধর্মতলায়। নিজস্ব চিত্র

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:০৭
Share: Save:

এত খুশি কোথায় রাখি!

খুশির ঝড়ে ভেসে গিয়ে অতএব বাড়তি খুশি বিলি না-করলেই নয়। সকাল থেকে রাত, জনে জনে সেই খুশি উপচে পড়ছে। এ দেশে স্মার্টফোন-দুরস্ত নেট-নাগরিকদের জীবনে সাম্প্রতিকতম খুশিটি ‘জাতির জনক’কে ঘিরে। মঙ্গলবার, ২ অক্টোবরের সকাল তাই ফোনে ফোনে কড়া নেড়েছে ‘হ্যাপি গাঁধী-জয়ন্তী’। এই তো ক’দিন আগে ‘হ্যাপি গণেশ ডে’ কিংবা বিশ্বকর্মা পুজোর ধাক্কা গিয়েছে। প্রায়ই একই সময়ে ছিল মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মহরম। ইমামদের তরফে বিবৃতি দিয়ে বোঝানো হয়, মহরম-মাসের ১০ তারিখের অনুষ্ঠানটি কোনও আনন্দের উৎসব নয়। বরং দিনটি শোকের, প্রার্থনার। এই দিনে শুভেচ্ছা পাঠানোর মানেই হয় না। তার পরেও কিছু উদ্ভট ‘মেসেজ’ ঠিক হোয়াটসঅ্যাপের পাতায় ছিটকে এসেছে!

বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই গায়ে জ্বর আসছে, কারণ সামনে পুজো। দেবীপক্ষের আগে ‘হ্যাপি মহালয়া’ থেকে শুরু করে প্রতিটা দিন ধরে ধরে হ্যাপি তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী থেকে বিজয়া দশমী— খুশি বিলোনোয় বিরাম নেই। বারো মাসে তেরো পার্বণ, কথাটা তো বস্তাপচা। দেশি-বিদেশি পার্বণের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। ক্যালেন্ডারের পাতা শেষ হয়ে নতুন ক্যালেন্ডার পড়বে। তবু আনন্দের অন্ত নেই।

এতে দানা বাঁধছে আশঙ্কাও। যা দিনকাল, তাতে কারও মৃত্যুসংবাদ শুনেও বোধহয় এ বার শুভেচ্ছা জানানো হবে। যেমন ইতিমধ্যেই ফেসবুকে ‘আমার প্রিয়জন অসুস্থ’, বা ‘অমুককে হারালাম’-গোছের মন্তব্যের নীচেও ‘লাইক’-এর ধুম লেগে যায়। তবে কি কারও বাবার বাৎসরিক বা মায়ের অসুখের কথা শুনেও এ বার আমরা অভিনন্দন জানাতে তৎপর হয়ে উঠব?

প্রশ্ন শুনে হাসছিলেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ‘‘সত্যি, গাঁধী জয়ন্তীতে কাউকে শুভেচ্ছা জানানোর কি মানে হয়? কারও শহিদ দিবসটিও এ বার হয়তো আনন্দ-উপলক্ষ বলে চিহ্নিত হয়ে যাবে।’’ এমনিতেই এ দেশে আনাড়ি নেটিজেনদের বড় অংশ কিছুই না বুঝে রাতদিন ‘সুপ্রভাত’, ‘শুভ রাত্রি’ পাঠিয়ে থাকেন। এত শুভেচ্ছা-বার্তায় কার্যত সিঁটিয়ে থাকেন অভিনেত্রী তথা নাট্য পরিচালক সোহিনী সেনগুপ্ত। তিনি বললেন, ‘‘আমি এ সব মেসেজের বাড়াবাড়ি দেখলে সটান ব্লক করে দিই। আমার চেনা কেউ হলেও রেয়াত করি না।’’ তবু এ মেসেজ জলতরঙ্গ রোধিবে কে? সোহিনীর ব্যাখ্যা, ‘‘কী করছি না ভেবে আলটপকা কিছু একটা করে ফেলতে আমরা ওস্তাদ।’’ মানে সেই, ‘আজকে দাদা যাবার আগে, বলব যা মোর চিত্তে লাগে /নাই বা তাহার অর্থ হোক, নাই বা বুঝুক বেবাক লোক!’ যা করছি কেন করছি, তা নিজেই জানি না।

কেন এই প্রবণতা? দেশের প্রাক্তন আইএএস কর্তা তথা ইতিহাস-সংস্কৃতির গবেষক জহর সরকারের কথায়, ‘‘হোয়াটসঅ্যাপে আপাত নিখরচায় জনে জনে সম্ভাষণ জানানোর সুযোগটা বড় ব্যাপার।’’ এই সুযোগেও ভোল পাল্টে যাচ্ছে আমবাঙালির। শীর্ষেন্দুবাবু বা জহরবাবু দু’জনেই মনে করেন, যে কোনও উপলক্ষে এই গণ শুভেচ্ছা জানানোর হিড়িক বাঙালির সাংস্কৃতিক জিনে নেই। কখনও ছিল না।

শীর্ষেন্দুবাবুর মত, ‘‘আগে জন্মদিনেও মায়েরা পায়েস করতেন। বন্ধুরা অবধি আগ বাড়িয়ে ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ বলতেন না।’’ জহরবাবুর দাবি, ‘‘শুভ বিজয়া বলার রীতিও বিশ শতকের বাঙালির অভ্যাস।’’ সাহেবদের সংস্পর্শে আসার আগে জাতপাতে দীর্ণ বাঙালি সমাজ শুভেচ্ছার তোয়াক্কাই করত না বলে তাঁর অভিমত। উত্তর ভারতীয়দের ধাঁচে ‘নমস্তে’ বলার চলও তেমন ছিল না। অবান্তর শুভেচ্ছা জানানোর প্রবণতাটি তাই ‘ধার করা সংস্কৃতি’, বলতে দ্বিধা নেই শীর্ষেন্দুর।

এ সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পরেও অবশ্য যুগের নিয়মে নড়চড় নেই। কার শুভ, কিসে শুভ— বোঝারও দরকার নেই। প্রযুক্তির হাত ধরে মিছিমিছি কাছে আসার ছলনায় যান্ত্রিক শুকনো শুভেচ্ছাটুকুই যা সম্বল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mahatma Gandh Birthday Social Media Wishes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE