তাণ্ডবের পরে। (ইনসেটে) চলছে সংঘর্ষ। — নিজস্ব চিত্র।
দূরে দাঁড়িয়ে পুলিশ। তাঁদের লক্ষ করে এক যুবক সোমনাথ নামে আর এক যুবককে চিৎকার করে বলছে, ‘‘মার, মার, পুলিশকে মার। পুলিশকে ফায়ারিং কর।’’
কথা শেষ হওয়া মাত্রই পুলিশের সামনে এসে পড়ল তাজা বোমা। চলল গুলিও। মুড়ি-মুড়কির মতো রাস্তায় বোমা ফাটছে। আতঙ্কে দোকান বা গলিতে ঢুকে প্রাণ বাঁচাচ্ছে পুলিশ। সিনেমা নয়, মঙ্গলবার ভরদুপুরের ঘটনা।
আগে নিউ টাউনের সিন্ডিকেট সংঘর্ষ বা হরিদেবপুরের সাম্প্রতিক গোলমালের সাক্ষী থেকেছে শহর। এ বার সিন্ডিকেট নিয়ে গোষ্ঠী সংঘর্ষে রণক্ষেত্রের চেহারা নিল খাস কলকাতার ট্যাংরা। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ ট্যাংরা থানা থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে বৈশালী মোড়ে ওই ঘটনায় ইটের ঘায়ে আহত হন ওই থানার সাব ইনস্পেক্টর অলীক কাবাসি। পুলিশ জানায়, ১২টি বোমা, চার রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত ছ’জন গ্রেফতার হয়েছে। ধৃতদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারধর, পুলিশের কাজে বাধাদান, খুনের চেষ্টা, অস্ত্র আইন-সহ একাধিক জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। ঘটনাস্থলে দু’টি তাজা বোমা ও কার্তুজ মিলেছে।
স্থানীয়েরা জানান, এলাকায় তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠী রয়েছে। এক দিকে প্রদীপ গুহ ও মনোজ হাজরার লোকজন। অন্য দিকে অলোক খাটুয়ার দল। দু’তরফেরই অভিযোগ, অন্য পক্ষ আগে সিপিএম করত। ক্ষমতা বদলের পরে তৃণমূলে এসেছে। এর জেরেই এলাকা দখল ঘিরে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ। মঙ্গলবারের ঘটনা তারই অঙ্গ। মনোজের বৌদি শম্পা হাজরা জানান, সোমবার রাতে স্থানীয় কুলীন খটিক রোডে এক মন্দিরে পুজো নিয়ে বিবাদের সূত্রপাত। সেখানে পুজো করছিলেন মহিলারা। ছিলেন প্রদীপের লোকজনও। অভিযোগ, মিন্টু নামে অলোক-ঘনিষ্ঠ এক যুবক সদলে এসে গালিগালাজ শুরু করেন। প্রদীপ-মনোজের লোকেরা রুখে দাঁড়ালে তখনকার মতো মিন্টুরা চলে যান। কিছু পরেই দক্ষিণ ট্যাংরা রোড দিয়ে মনোজ বাড়ি ফেরার সময়ে অলোকের দল গাড়ি থেকে নামিয়ে তাঁকে মারধর করে। স্থানীয়েরা এসে পড়লে পালায়। রাতেই ট্যাংরা থানায় অভিযোগ করে মনোজের পরিবার। কেউ গ্রেফতার না হওয়ায় মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ থানার সামনে বিক্ষোভ শুরু করে প্রদীপ ও মনোজের দলবল।
অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে কথা চলাকালীন অলোকের দল থানার সামনেই প্রদীপদের দিকে বোমা ছোড়ে। দু’তরফে বোমাবাজি শুরু হয়। পুলিশকে লক্ষ করে ইট, গুলি ও বোমা ছোড়া হয়। রাস্তাঘাট ভরে যায় কাচ ও ইটের টুকরোয়। এলাকায় আতঙ্ক ছড়ায়। সংঘর্ষে দু’পক্ষেরই লোকই কমবেশি আহত হন। পরে বিশাল পুলিশবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি সামলায়।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার রাজীব মিশ্র বলেন, ‘‘এলাকা দখল ঘিরে দু’পক্ষে বোমা, গুলি, ইটবৃষ্টি চলে। এক এসআই-এর মাথা ফাটে। দুই কনস্টেবল আহত হন। দু’পক্ষই অভিযোগ দায়ের করেছে। পুলিশও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা রুজু করেছে।’’
স্থানীয়েরা জানান, এলাকা দখল নিয়ে তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী অলোক ও প্রদীপদের বিবাদ বহু পুরনো। কোনও প্রোমোটার এলে প্রথমে এলাকার দাপুটে নেতাদের টাকা দিতে হয়, তাঁদের পছন্দের লোকের থেকেই নির্মাণসামগ্রী কিনতে হয়। ইদানীং প্রদীপের প্রভাব বাড়ছিল। তাই বিবাদ চরমে ওঠে বলে অভিযোগ। যদিও অলোকের অনুগামীদের পাল্টা অভিযোগ, অলোক এলাকার নেতা। সম্প্রতি মনোজ এলাকা দখল করতে চাওয়ায় ওই বিবাদ।
স্থানীয় ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৃণমূলের স্বপন সমাদ্দার অবশ্য বলেন, ‘‘দুষ্কৃতীর সঙ্গে ঝামেলা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হতে পারে না। ওরা দু’জনেই তৃণমূলের কর্মী। কিন্তু এটা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নয়।’’ নিজে তৃণমূল করেন মেনে মনোজ বলেন, ‘‘প্রোমোটারির অভিযোগ ঠিক নয়। এর বেশি কিছু বলব না। যা বলার আমার নেতৃত্ব বলেছেন।’’ আর অলোকের মোবাইল এ দিন বন্ধ ছিল।
মেয়র তথা কলকাতা জেলা তৃণমূলের সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা হস্তক্ষেপ করব না। পুলিশ আইনানুযায়ী যা করার করবে।’’ তাঁর হুঁশিয়ারি— যারা ঘটনা ঘটাবে, দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। দল মাথা গলাবে না।’’ যদিও দলের দাবি, দু’পক্ষের অভিযুক্তদেরই গ্রেফতার করা উচিত।
ঘটনায় তৃণমূলের এক বিধায়ক এবং এক সাংসদের নাম জড়িয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, অলোক ও প্রদীপের নেপথ্যে রয়েছেন এই দুই হেভিওয়েট নেতা। এলাকার রাজ্যস্তরের এক নেতা অভিযোগ অস্বীকার করেন। স্থানীয় বিধায়ক তৃণমূলের স্বর্ণকমল সাহা অবশ্য বলেন, ‘‘দলের কেউ জড়িত থাকলেও আইন আইনের পথে চলবে। অপরাধীকে দল মান্যতা দেবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy