Advertisement
১৭ মে ২০২৪
নেতাজিনগর

কমে গিয়েছে আড্ডা, হারিয়েছে আন্তরিকতাও

১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি যখন দেশ জুড়ে প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্‌যাপিত হচ্ছে, ঠিক সেই দিন দক্ষিণ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হল একটি উদ্বাস্তু কলোনি, যার নাম নেতাজিনগর। তখন থেকেই এ পাড়ায় আমাদের পরিবারের বসবাস।

বিশ্বজিৎ গুহ
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৬ ০০:৫০
Share: Save:

১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি যখন দেশ জুড়ে প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্‌যাপিত হচ্ছে, ঠিক সেই দিন দক্ষিণ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হল একটি উদ্বাস্তু কলোনি, যার নাম নেতাজিনগর। তখন থেকেই এ পাড়ায় আমাদের পরিবারের বসবাস।

শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত দেখা পরিবর্তনের কথাই যদি বলি, এক-এক সময়ে তো নিজেই অবাক হয়ে যাই পাড়া ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাটা দেখে। আজকের নেতাজি নগর মানেই প্রশস্ত পিচের রাস্তা, অসংখ্য ঝাঁ-চকচকে বহুতল, আলো ঝলমলে অভিজাত দোকান। এর পাশাপাশি বাড়তে থাকা নামী রেস্তোরাঁ, মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং বদলানো রুচি তুলে ধরে পরিবর্তনশীল ছবিটা। এক কালের পাড়ার একতলা, দোতলা মধ্যবিত্ত বাড়িগুলির জায়গায় একে একে মাথা তুলেছে তাক লাগানো বহুতল। মধ্যবিত্তের পাশাপাশি এসেছেন উচ্চমধ্যবিত্ত বাঙালি, এমনকী অবাঙালিরাও। সময়ের সঙ্গে এলাকার উন্নতি হয়েছে। উন্নত হয়েছে নিকাশি, জঞ্জাল অপসারণ ব্যবস্থা। নিয়মিত রাস্তা পরিষ্কার হয়। নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এলাকাটা পরিচ্ছন্ন থাকে।

বাইরের চেহারা আকর্ষণীয় হলেও ক্রমেই মলিন হয়েছে অন্তরের চেহারা। হারিয়ে যাচ্ছে অন্তরঙ্গতা। কমেছে সহানুভূতি এবং বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাসও। বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই একা বেঁচে থাকায় অনেকেই যেন সুখের সন্ধান পাচ্ছেন। তবে এখনও এ
পাড়ায় কিছুটা হলেও মানুষে মানুষে যোগাযোগ আছে।

এ অঞ্চলে আছে‌ কিছু সমস্যাও। যেমন পানীয় জলের সমস্যা। রানি দিঘির পাশে কেএমডিএ-র জলাধার থাকা সত্ত্বেও এলাকার মানুষ জলকষ্টে ভুগছেন। নেতাজিনগর থানার বিপরীতে বিশাল ওভারহেড ট্যাঙ্ক জরাজীর্ণ অবস্থায় ভেঙে পড়েছে। আশার কথা, সেখানেই তৈরি হচ্ছে একটি বুস্টার পাম্পিং স্টেশন। কাউন্সিলর মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী উন্নয়নে উদ্যোগী। উন্নয়নে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে রানি দিঘি সংস্কার ও সংরক্ষণে তাঁর ভূমিকা প্রশংসনীয়।

এখানেও রয়েছে সুসজ্জিত পার্ক এবং উদ্যান। খেলাধুলোর ক্ষেত্রেও নেতাজিনগরের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। পাড়ায় পাড়ায় আয়োজন করা হত ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং ক্রিকেট ম্যাচ। এ ছাড়াও যুব সম্প্রদায়কে শিক্ষার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করতে কাছাকাছির মধ্যে বেশ কয়েকটি পাঠাগারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। সেই সময়ে বিভিন্ন ক্লাবগুলির মধ্যে বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হত। তবু আক্ষেপ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য এখানে নেই কোনও প্রেক্ষাগৃহ। ক্লাবগুলির উদ্যোগে এখনও হয় রক্তদান শিবির, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা। সেই সত্তরের দশকের দিনগুলি ছাড়া এলাকাটি শান্তিপূর্ণ। এক সময়ে এখানে থাকতেন চলচ্চিত্র অভিনেতা নিরঞ্জন রায়, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, সুখেন দাস, অজয় দাস প্রমুখ। নেতাজিনগরে রয়েছে নাট্যচর্চার ঐতিহ্যও। আগে, নেতাজি সঙ্ঘের উদ্যোগে বেশ কিছু নাটক মঞ্চস্থ হত। সেগুলি দেখতে আশপাশের অঞ্চলের মানুষ ভিড় করতেন। এখন অবশ্য অন্য একটি ক্লাবের উদ্যোগে নাটকের আয়োজন করা হয়। আজও আছে দক্ষিণী সঙ্গীত সংস্থার ধ্রুপদী সঙ্গীতানুষ্ঠান। এখনও ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

নেতাজিনগরের আড্ডাও বিখ্যাত। জীবনদার মিষ্টির দোকানে এক সময়ে নানা ধরনের মানুষ এসে আড্ডা জমাতেন। আমরাও জড়ো হতাম। দোকানটা এখন আর নেই। তবু আড্ডা বসে। তবে অতীতের কৌলিন্য নেই।

অতীতের নেতাজিনগরের চেহারাটাই আজ খুঁজে পাওয়া ভার। পাঁচের দশকটা ছিল নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও সংগ্রামে ভরা। ১৯৬০-এর দশকে এসেছিল কিছুটা স্থিতি। সাতের দশক থেকে শুরু হল উদ্বাস্তু পরিবারগুলির আর্থিক উন্নয়ন। সেই সময়ে কলোনির মানুষগুলোর খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের পাশাপাশি অন্যতম উপলব্ধি ছিল শিক্ষার প্রসার। সেই উপলব্ধি থেকেই ১৯৫১ সালে এক রাতে অবিশ্বাস্য ভাবে বহু মানুষের সম্মিলিত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছিল নেতাজিনগর বিদ্যামন্দির। তৈরি হয় নেতাজিনগর বালিকা বিদ্যামন্দিরও। ১৯৬৭-তে গড়ে ওঠে নেতাজিনগর কলেজ। এখন এখানে তিনটি কলেজ রয়েছে।

প্রথম দিকে নেতাজিনগরে বেশির ভাগ বাড়ি-ঘর ছিল দরমার বেড়া, টালি কিংবা টিনের ছাউনির। ছয়ের দশকের শেষ ভাগ থেকে ক্রমেই একতলা, দোতলা বাড়িগুলি গড়ে উঠতে শুরু করল। অতীতের মেঠো রাস্তার আজ আর অস্তিত্ব নেই। সর্বত্রই ঝাঁ-চকচকে মসৃণ পিচের প্রশস্ত রাস্তা। পুরনো বাড়িগুলির জায়গায় মাথা তুলেছে বহুতল। কলোনির পুরনো সংস্কৃতির উপরে আঘাত আনছে ফ্ল্যাট কালচার।

আজ যেখানে গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার্স, সেখানেই বহু সংখ্যক গাছ থাকায় মনে হত জঙ্গল। আগে পাড়াটা খুব সবুজ ছিল। এখন এখানে গাছগাছালির সংখ্যা কমে গিয়েছে। মনে পড়ে ঝড়ের সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে আম কুড়োতে যাওয়া কিংবা নির্জন দুপুরে অভিভাবকদের চোখ এড়িয়ে গাছে উঠে পেয়ারা, জামরুল পাড়ার সেই আনন্দ। আজ মনে হয়, অতীতের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ মেঘমুক্ত হয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল হয়েছে।

লেখক প্রাক্তন অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Old group Tea
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE