চার দেওয়ালের বাইরেই বেজেছে ঢাক। রাস্তায় নামা মানুষের ঢল দেখতে পেয়েছেন ওঁরা। নতুন পোশাক পরে সবাই বেরিয়েছে পুজো দেখতে। ওই আনন্দ-উৎসবের খুব কাছ থেকেও যে ওঁরা অনেক দূরে। উৎসবের দিনগুলিতেও হাসপাতালের প্রতীক্ষালয়ে বসে বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন। কারণ, ওঁদের প্রিয়জনেরা ভর্তি হাসপাতালে। আর জি কর, বি সি রায়, নীলরতন বা এসএসকেএম— সর্বত্রই দেখা গিয়েছে এই দৃশ্য। সেখানকার রোগীদের পরিজনেরা জানালেন, এ বার পুজোয় মণ্ডপে গিয়ে ঠাকুরের মুখও দেখা হয়নি ওঁদের।
বেলেঘাটার বি সি রায় শিশু হাসপাতালে গত দু’মাস ধরে ভর্তি রয়েছে ধানবাদের ঝ়রিয়ার বাসিন্দা রবিন দত্তের আঠেরো মাসের ছেলে রাজদীপ। স্নায়ুর রোগে ভুগছে সে। রবিন তাঁর স্ত্রী ও শ্যালককে নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন ওই হাসপাতালের প্রতীক্ষালয়ে। তাঁর কথায়, ‘‘গত বছর পুজোর কয়েক মাস আগে আমার ছেলে হল। তখন কী আনন্দ। ওইটুকু ছেলেকে কোলে নিয়েই চলে এসেছিলাম পুজো মণ্ডপে। সেই ছেলে এখন এইচডিইউ-এ ভর্তি। কী ভাবে আর পুজো দেখব?’’ রবিন জানান, ঝড়িয়ায় তাঁদের পাড়ার পুজোয় প্রধান উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি এক জন। প্রতিমা মণ্ডপে আনা থেকে বিসর্জন— সব কিছুতেই তাঁকে থাকতে হয়। এ বার শুধুই তার স্মৃতিচারণা। রবিন বলেন, ‘‘গত বার ছেলেকে কোলে নিয়ে মণ্ডপে অনেক ছবি তুলেছিলাম। সেই ছবিগুলো মোবাইলে রাখা আছে। এ বার পুজোয় হাসপাতালে বসে সেগুলোই আবার দেখেছি।’’
ওই হাসপাতালেই রীতা বিশ্বাসের ছেলে প্রিতম বিশ্বাস ভর্তি রয়েছে গত এক মাস ধরে। তাঁদের বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার তাহেরপুরে। রীতা বললেন, ‘‘প্রতীক্ষালয়ে বসে বসেই ঢাকের আওয়াজ শুনেছি। শুনেছি, এই হাসপাতালের কাছেই একটা বড় পুজো হচ্ছে। কিন্তু দেখতে যেতে একদমই ইচ্ছে করেনি।’’ রীতা জানান, কলকাতায় ছেলেকে নিয়ে এসে ঠাকুর দেখার অনেক দিনের ইচ্ছে তাঁর। কিন্তু কোনও বারই হয়ে ওঠেনি। এ বার কলকাতাতেই ছিলেন মা-ছেলে। কিন্তু ঠাকুর দেখার পরিস্থিতি ছিল না।
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রতীক্ষালয়ে গিয়ে দেখা গেল, বসিরহাট থেকে ঠাকুর সরকার নামে এক নিকটাত্মীয়কে নিয়ে এসেছেন কবিতা সরকার। কবিতা বললেন, ‘‘আমরা তো ওঁকে ছাড়া পুজোর আনন্দই করতে পারি না। উনি গত পনেরো দিন ধরে আইসিইউ-তে ভর্তি।’’ ওই হাসপাতালেই চার বছরের ছেলে সুবাইদ ইসমাইলকে নিয়ে এসেছেন শ্যামলী বিবি। তিনি জানান, ছেলের নাভির কাছে একটা সংক্রমণ হয়েছে। সেখান থেকে
জ্বর। কমছে না কিছুতেই। শ্যামলী বললেন, ‘‘দুর্গাপুজোয় সব ধর্মের লোকই আনন্দ করেন। আমার ছেলেও তো সারা দিন বন্ধুদের সঙ্গে মণ্ডপে থাকে। ওকে ছাড়া আমরা কী ভাবে পুজোয় আনন্দ করব? তাই এ বছরটা আর পুজো দেখা হয়নি।’’
এসএসকেএম হাসপাতালের কাছে বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজিতে গত ছ’মাস ধরে ভর্তি মালদহের সাগর সেন। তাঁর পরিবার ঠাঁই নিয়েছে এসএসকেএমের প্রতীক্ষালয়ে। সাগরবাবুর মেয়ে সুমিত্রা সেন বলেন, ‘‘গত বছরের পুজোয় কত মজা করেছিলাম। এ বার সব পাল্টে গেল। সামনের রাস্তাতেই কত আলো। মানুষকে আনন্দে মেতে উঠতে দেখলাম। আর আমাদের রাত কাটল শুধুই দুশ্চিন্তা করে।’’