বৌবাজারের অনাথ আশ্রমে মায়ের সঙ্গে গণেশ। নিজস্ব চিত্র
বাইপাসের ধার ঘেঁষে একচিলতে ঝুপড়ির সামনে দশ দিনের সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে ‘পাগলি’ মা। কোমরের সঙ্গে সন্তানকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে কখনও তাকে স্তন্যদান করছেন, কখনও আবার আপন খেয়ালে ধুলোবালি মাখাচ্ছেন। ২০০৭ সালের মহালয়ার সকালে এই খবর জানাজানি হওয়ার পরে বৈষ্ণবঘাটা পাটুলির ফুটপাত থেকে পরম মমতায় শিশুটিকে তুলে এনেছিলেন বৌবাজারের একটি অনাথ আশ্রমের কর্মকর্তারা। বাদ যাননি সেই মা-ও। সে দিনের সেই দুধের শিশু আজ সকলের প্রিয় গণেশ। নিজের জীবনে মহালয়ার তাৎপর্য এখনও সে ভাবে জানে না সে। শুধু জানে, দুর্গাপুজো মানে সকলে মিলে প্রভাতফেরি, আর তার পরে আশ্রম ফাঁকা করে বন্ধুদের বাড়ি চলে যাওয়া।
বৌবাজারের ওই অনাথ আশ্রম বর্তমানে প্রায় সাড়ে তিনশো ছেলেমেয়ের ঠিকানা। তাদের মধ্যে অবশ্য সকলেই পিতৃমাতৃহীন নয়। রাজ্যের আনাচেকানাচের দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের ঠাঁই মেলে এই হোমে। দুর্গাপুজো তাদের কাছে ঘরে ফেরার সময়। কিন্তু ফেরা হয় না চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র গণেশের। কারণ, ফেরার মতো কোনও ঠিকানাই নেই তার। তাই সে বলে, ‘‘সপ্তমী পর্যন্ত বন্ধুরা থাকবে। ওরা চলে গেলে দুঃখ হয় না ঠিকই, তবে একা একা ভাল লাগে না।’’ আর মা? গণেশের জবাব, ‘‘মা তো বাইরে যেতে চায় না। তাই ঘরেই থাকে।’’ গণেশের মতো কোথাও যাওয়ার নেই কার্তিকেরও। কারণ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের আস্তাকুঁড়ের পাশ থেকে ছোট্ট কার্তিক ও তার মানসিক ভারসাম্যহীন মাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছিল এই হোমে। পুজোর দিনগুলোয় প্রায় সমবয়সী এই কার্তিকই গণেশের খেলার সঙ্গী।
বৌবাজারের এই হোমে পুজোর ক’টা দিন রয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের জন্য অবশ্য গত কয়েক বছর ধরে দুর্গাপুজো শুরু করেছেন কর্তৃপক্ষ। এই আশ্রমের কর্ণধার এবং প্রাক্তন সিএবি কর্তা বিশ্বরূপ দে বলছেন, ‘‘যারা রয়ে গেল, তাদের কথা ভেবেই পুজো শুরু করেছিলাম। পুজোর প্রস্তুতিতে ভীষণ ভাবেই জড়িয়ে থাকে ওরা।’’ তবে পুজোর কাজ থেকে নিজেকে আলাদা করেই রাখেন গণেশের মা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে আসা সেই ‘পাগলি’ মায়ের কথাবার্তা অবশ্য এখনও কিছুটা অসংলগ্ন। প্রশ্ন করায় কখনও বলেন, ‘‘আমার ছেলে যেখানেই থাকুক, তুমি দাঁড়িয়ে থাকো।’’ আবার কখনও বলেন, ‘‘তুমি এখানে বোসো না। ওরা তা হলে তোমায় নিয়ে যাবে।’’
সংবাদপত্রে প্রকাশিত সেই খবর।
সমাজকল্যাণ দফতর এবং জনশিক্ষা দফতর থেকে পাঠানো বহু দুঃস্থ ছেলেমেয়ের ঘর এই অনাথ আশ্রমটি। বছরের বাকি সময়টা পরিবারের কাছে ‘ব্রাত্য’ এই ছেলেমেয়েদের পুজোর সময়ে বাড়ি ফিরতে খুব একটা খারাপ লাগে না। মালদহের মেয়ে, ছোট্ট মনীষার কাছে পুজো মানে শুধুই ‘মায়ের কাছে যাব’ বুলি আওড়ানো। বাড়িতে তার মা-বাবা-ভাই। তবু সে কেন সুদূর কলকাতার অনাথ আশ্রমে, সেই সদুত্তর মেলে না। শুধু লজ্জায় অধোবদন মেয়েটি কোনও রকমে বলে, ‘‘পুজোর পরে ফিরে আসতে দুঃখ হয়।’’
পুজোয় এই দুঃখই সঙ্গী শহরের অধিকাংশ অনাথ আশ্রমের আবাসিকদের। দক্ষিণ কলকাতার হালতুর আর একটি অনাথ আশ্রমের আবাসিক সুপ্রিয়া অথবা অন্তরের কাছে পুজোয় বাড়ি ফেরা ছাড়া আর তেমন কোনও আকর্ষণ নেই। অল্প বয়সে বিয়ে-বধূ নিগ্রহের শিকার, পরিবার প্রত্যাখ্যাত সুপ্রিয়া এখন নিজের প্রচেষ্টায় লড়াই করে শহরের এক নামী কলেজের ছাত্রী। মায়ের সঙ্গে ঝগড়ার জেরে বাবা তাকে মাটিতে ছুড়ে ফেলায় ছোট থেকেই বছর দশেকের অন্তর স্থায়ী অসুস্থতার শিকার। এদের কাছে পুজো কোনও উৎসব নয়। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী মানসী গুহঠাকুরতা বলছেন, ‘‘প্রতিদিনের রুটি-তরকারির বদলে এক দিন পাতে চিকেন-মাটন পড়লে সেটাই ওদের কাছে অনেক। ওদের পুজো কেমন কাটবে, তা অন্যের উপরে নির্ভর করে।’’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাদের উদ্যোগে জামাকাপড় বিলি অথবা এক দিন বাসে করে পুজো পরিক্রমা— ‘অনাথ’ এই শিশুদের কাছে দুর্গাপুজো এখানেই শেষ।
আর ভবিষ্যৎ? বিশ্বরূপবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘অনাথ আশ্রমগুলিতে এই বাচ্চাদের ১৮ বছরের বেশি থাকার সরকারি নিয়ম নেই। কিন্তু তার পরে তাদের কী হবে, তা নিয়ে সরকারেরও কোনও ভাবনা নেই। তাই এখান থেকে বেরিয়ে ওদের কী হবে, কেউ জানে না।’’
তবে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে আটকায় না ওদের। তাই তো সমাজের অসুরদমনে পুলিশ হতে চায় গণেশ। বলে, ‘‘বড় হয়ে পুলিশ হব। যাতে কেউ কোনও খারাপ জিনিস না করতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy