(বাঁ দিকে) আঙুল উঁচিয়ে তেেড় এলেন নিজেকে তৃণমূলের ‘পোর্টফোলিও’ বলে পরিচয় দেওয়া সেই ব্যক্তি। (ডান দিকে) রূপা বাগচী। শনিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
প্রথমে দলীয় কর্মীদের পিঠে আলতো ধাক্কা। তার পরে নাগাড়ে অশ্লীল গালিগালাজ। পাঞ্জাবির হাতাটা গুটিয়ে, সানগ্লাস মাথার উপরে তুলে এক জন বললেন, ‘‘শাড়িটা টান মেরে খুলে দে। তা হলেই বুথে বুথে ঘোরা বন্ধ হয়ে যাবে।’’ যাঁকে উদ্দেশ্য করে বলা, তিনি কলকাতা পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী, তিন-তিন বারের জয়ী সিপিএম কাউন্সিলর রূপা বাগচী। নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের ‘সোনালি শিবির’ ক্লাবের বুথে শনিবার সকালে এমনই ‘অভ্যর্থনা’ জুটল তাঁর।
ওই বুথে বৈধ ভোটারদের বার করে দেওয়া হচ্ছে, ভোট প্রক্রিয়া ইচ্ছাকৃত ভাবে শ্লথ করে দেওয়া হচ্ছে— এমন অভিযোগ আসছিল নানা জায়গা থেকেই। সেই সব সরেজমিন দেখতে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও গিয়েছিলেন ওই বুথে। রূপার আশপাশে সাংবাদিকদের ওই ভিড় দেখে দলবল নিয়ে ফের সক্রিয় হলেন পাঞ্জাবি পরা ওই মধ্যবয়স্ক। রীতিমতো তেড়েফুঁড়ে উঠে বললেন, ‘‘কী ব্যাপার, এখানে প্রধানমন্ত্রী এসেছে নাকি যে এমন ভিড় করছেন? বেরোন এখান থেকে।’’ তাঁকে প্রশ্ন করা হল, আপনি এ সব বলার কে? জবাব এল, ‘‘আমি পোর্টফোলিও।’’
পোর্টফোলিও বলতে কী বোঝাচ্ছেন? তিনি বললেন, ‘‘পোর্টফোলিও মানে তৃণমূলের পোর্টফোলিও। এটুকুই যথেষ্ট। আর কিছু জানার দরকার নেই।’’ নাম? সদর্পে উত্তর, ‘‘পল্লব চক্রবর্তী।’’ আপনি এ ভাবে ধাক্কাধাক্কি করছেন কেন? উত্তর, ‘‘অপ্রয়োজনীদের এখান থেকে বার করে দিচ্ছি। এটাই আমার দায়িত্ব।’’ দায়িত্বটা দিল কে? শ্রীযুক্ত পল্লবের জবাব, ‘‘আমরা নিজেরাই দায়িত্ব নিয়েছি। কাউতে দিতে হয়নি।’’
ততক্ষণে ওই ‘পোর্টফোলিও’র আশপাশের জটলা বড় হচ্ছে। মারমুখী সেই জটলা বেছে বেছে ধাক্কা দিচ্ছে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ভোটারকে। গলির মুখে আটকে দিচ্ছে ভোট দিতে আসা একাধিক পরিবারকে। ঠান্ডা গলায় বলছেন, ‘‘বাংলা ভাষা বোঝেন তো? আপনারা বাড়ি যান। ভোট সময়মতো পড়ে যাবে।’’
ওই জটলাকেই ঘণ্টাখানেক পরে দেখা গেল অন্য একটি বুথে। সেখানেও ‘অপ্রয়োজনীয়’ ভিড় হটাচ্ছেন তাঁরা। উত্তেজিত হয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন রূপা বাগচী। উঠ়লেন দাঁড়িয়ে থাকা অটোয়। দিনভর ওই অটোই ছিল তাঁর বাহন। অটোয় উঠে একের পর এক নম্বর ডায়াল করছেন। প্রথমে স্থানীয় থানার ওসি। ‘‘এটা কী হচ্ছে বলুন তো? এতটা বাড়াবাড়ি ভাবতে পারিনি।’’ পরক্ষণেই অন্য ফোনে, ‘‘আমি কিন্তু কাল রাতেই আপনাদের বলেছিলাম, বাইরে থেকে ছেলে ঢুকছে। আপনারা কিচ্ছু করলেন না!’’
এরই মধ্যে খবর এল প্রমোদ দাশগুপ্ত কলোনির বাসিন্দারা ভোট দিতে বেরোতে পারছেন না। কলোনিতে ঢুকতেই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন সকলে। অভিযোগ, শুক্রবার রাত থেকেই পিস্তল-ভোজালি নিয়ে তাঁদের ভয় দেখানো হচ্ছে। ‘‘আমারা পড়ে পড়ে মার খাব নাকি?’’ রূপা বললেন, ‘‘সকলে এককাট্টা হয়ে এগোও। দেখি কে আটকায়!’’
সিপিএমের দাপুটে নেত্রী হিসেবেই পরিচিত রূপা। এক দফা বিধায়কও হয়েছিলেন। শুক্রবার রাত থেকে তিনিই বারবার বলছেন, ‘‘কিছুই ভাল ঠেকছে না।’’ এ দিন সকাল থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে ‘খারাপ’ খবর আসছে। কেউ বলছেন, বাড়ি থেকে না বেেরানোর জন্য তৃণমূল শাসিয়ে গিয়েছে। কেউ বা বলছেন, ভোট দিতে যাওয়ার পথেই তৃণমূলকর্মীদের হাতে মার খেয়েছেন। ভোর সাড়ে ছ’টাতেই নাকি মার খান তাপস চট্টোপাধ্যায় নামে পোলিং এজেন্ট। এরই মধ্যে দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ সিপিএমের স্থানীয় কমিটির সম্পাদক তাপস গুহরায় হন্তদন্ত ভাবে এসে বললেন, ‘‘এ বার কি বুথ থেকে এজেন্টদের তুলে নেওয়া হবে? সময় যত শেষ হয়ে আসবে, তত মারের বহর বাড়বে মনে হচ্ছে।’’ রূপা মাথা নাড়লেন। না, এত তাড়াতাড়ি জমি ছাড়া যায় নাকি?
ভোর থেকে টো টো করে মানিকতলা ইএসআই হাসপাতালের কাছেই একটি দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্রের লাগোয়া ঘরে বসলেন দেড়টা নাগাদ। জানালেন, আর কোথাও ঘোরার নেই। হাল ছেড়ে দিলেন? ম্লান হাসলেন। বলেন, ‘‘বহু জায়গাতেই দখল নিয়েছে ওরা। এই আশঙ্কাটা ছিলই। কিন্তু তার চেয়েও বেশি খারাপ লাগছে অন্য জায়গায়। বিরোধিতা তো থাকবেই। কিন্তু যে ভাষা আর ভঙ্গিতে আজ বিরোধিতার মুখোমুখি হলাম, সেটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy