কলকাতায় একটি বাড়ি করতে চান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সেই বাড়ি তৈরির অনুমতি চেয়ে ১৮৮১ সালে কলকাতা পুরসভার সচিবকে চিঠি লিখছেন তিনি। তাঁর ওই চিঠির গুরুত্ব বুঝে বিষয়টিকে যথাযোগ্য অগ্রাধিকার দিয়ে তদানীন্তন পুর সচিব বিদ্যাসাগরকে চিঠিতেই উত্তর দিচ্ছেন। এই দু’টি চিঠি পুরসভার হগ বিল্ডিংয়ের করিডরে বস্তাবন্দি হয়ে জঞ্জালের জায়গায় পড়ে ছিল চূড়ান্ত অবহেলায়। বিষয়টি পুরসভার আর্কাইভ বিভাগের গোচরে আসায় মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে ঘটনাটি জানানো হয়। মেয়র বলেন, ‘‘এমন বহু বস্তা উদ্ধার করেছি। সেইসব বস্তার মধ্যে অনেক পুরনো, দুষ্প্রাপ্য নথি আছে। আর্কাইভ বিভাগকে সমস্ত খতিয়ে দেখে নথিগুলি ডিজিটাইজ় করতে বলেছি।’’
পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৮৮১ সালের ১০ জুন পুরসভার তদানীন্তন সচিব, ব্রিটিশ সাহেব জর্জ টার্নবুলকে নিজের হাতে চিঠি লিখেছিলেন বিদ্যাসাগর। সেই চিঠিতে তিনি উত্তর কলকাতার বাদুড়বাগানের ২৫, বৃন্দাবন মল্লিক লেনের (অধুনা ৩৫, বিদ্যাসাগর স্ট্রিট) ঠিকানায় একটি একতলা বাড়ি তৈরির জন্য পুরসভার অনুমোদন চেয়েছিলেন। সেই সময়ে কলকাতা পুরসভার নাম ছিল ‘দ্য কর্পোরেশন অব দ্য টাউন অব ক্যালকাটা’। সেই চিঠি পাওয়ার পরে উত্তরে পুর সচিব টার্নবুল এবং পুর ইঞ্জিনিয়ার (ইঞ্জিনিয়ার টু দ্য কর্পোরেশন) জেমস কিমবার তাঁদের সই করা চিঠি বিদ্যাসাগরকে পাঠান।
ওই চিঠিতে টার্নবুল সাহেব লিখছেন, তদানীন্তন পুরসভার চেয়ারম্যান স্যর হেনরি হ্যারিসনের (যাঁর নামাঙ্কিত হ্যারিসন রোড পরে মহাত্মা গান্ধী রোড হয়েছে) সঙ্গে বিদ্যাসাগরের বাড়ি তৈরির বিষয়ে তাঁদের কথা হয়েছে। পুর ইঞ্জিনিয়ার জেমস কিমবারের সঙ্গে কথা বলে হ্যারিসন সাহেব এ বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন। টার্নবুল বিদ্যাসাগরকে লিখছেন, বিধি মেনে বাড়ি তৈরি করতে হবে। রাস্তার দিকের কোনও অংশ যেন দখল করা না হয়। দরজা, জানলা খোলার সময়ে রাস্তায় কারও যাতে অসুবিধা না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতেও চিঠিতে অনুরোধ করা হয়েছে বিদ্যাসাগরকে।
পুরসভার নথি ঘেঁটে জানা যাচ্ছে, ১৮৮১ থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত কলকাতা পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন স্যর হেনরি লেল্যান্ড হ্যারিসন। ১৮৬৩ সাল থেকে দীর্ঘ দিন পুরসভা ‘জাস্টিসেস অব পিস’-এর অধীনে ছিল। এখন যেমন পুরসভা একাধিক মেয়র পারিষদের অধীনে, যাঁদের শীর্ষে মেয়র। সে সময়ে তেমনই পুরসভা পরিচালনা করতেন ‘জাস্টিসেস অব পিস’। তাঁদের মাথায় ছিলেন চেয়ারম্যান। পুরসভার আর্কাইভ বিভাগের ওএসডি দীপঙ্কর গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘বছর চারেক আগে পুরসভার হগ বিল্ডিংয়ের চারতলার করিডরে হাঁটতে গিয়ে সার দিয়ে বস্তাবন্দি নথি চোখে পড়ে। সেগুলি ঘাঁটতে ঘাঁটতে পুরসভাকে লেখা বিদ্যাসাগরের চিঠি পাওয়া যায়। আবার তাঁকে পাঠানো উত্তর সংবলিত নথিও মেলে সেখানে। সঙ্গে সঙ্গে মেয়রের কাছে যাই। মেয়র পড়ে থাকা এমন চারশোটি বস্তা সংরক্ষণ করতে নির্দেশ দেন। সেখান থেকেই আমরা ধীরে ধীরে সমস্ত পুরনো নথি আর্কাইভের জন্য ডিজিটাইজ় করছি।’’
কিন্তু বিদ্যাসাগরকে পুরসভার পাঠানো চিঠি পুরসভার হাতেই আবার ফিরে এল কী ভাবে? এর স্পষ্ট উত্তর পুরসভার কাছেও নেই। তবে, মনে করা হচ্ছে, বিদ্যাসাগরের পরিবারের তরফেই পরবর্তী কালে সেগুলি সংরক্ষণের জন্য পুরসভার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
সেই দুই চিঠির প্রতিলিপি। ছবি: সংগৃহীত।
প্রসঙ্গত, কলকাতায় বিদ্যাসাগরের বাড়ি বলতে মূলত বাদুড়বাগানের ৩৫, বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের (আগের ২৫, বৃন্দাবন মল্লিক লেন) বাড়িটিকেই বোঝানো হয়। যা তাঁর শেষ জীবনের বাসস্থান ছিল ও যেখানে তাঁর বিপুল গ্রন্থসম্ভার রাখা ছিল। বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের ওই বাড়ি বর্তমানে হেরিটেজ তালিকায় রয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)