সার্বিক স্বাস্থ্য এবং ভাল থাকার ভিত্তিই হল মানসিক সুস্বাস্থ্য। অথচ গত দু’বছরে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ সেই ভিতেই আঘাত করেছে। সংক্রমণের জেরে বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব, বেতনে কোপ, একাকিত্ব, পড়ুয়াদের ঘরবন্দি হয়ে থাকা, বয়স্ক এবং অসুস্থদের নিয়মিত চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে বিপর্যস্ত মানসিক স্বাস্থ্য। বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন সংস্থার তরফে সে সবের সমীক্ষা চলছে। এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেটেও উঠে এল এই বিপর্যয় নিরসনের চেষ্টার কথা।
মঙ্গলবার ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষের বাজেট পেশের সময়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারাম ‘ন্যাশনাল টেলি মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রাম’-এর কথা ঘোষণা করেন। তিনি জানান, ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস’ (নিমহানস্)-এর সহযোগিতায় দেশে ২৩টি টেলি মেন্টাল হেলথ সেন্টার গড়ে উঠবে। সেখানে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নত মানের পরিষেবা মিলবে। যদিও এই ঘোষণার পরে মানসিক রোগের চিকিৎসক মহলের প্রশ্ন, ১৩০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশে প্রায় ২৫ কোটি মানুষের কোনও না কোনও মানসিক সমস্যা রয়েছে। মাত্র ২৩টি কেন্দ্র সেই প্রয়োজন কতটা মেটাতে পারবে? সমাজকর্মীদেরও প্রশ্ন, ‘নিজস্ব ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা না থাকলে কি প্রান্তিক স্তরের মানুষেরা মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা পাবেন না?’
গত বছর সারা দেশে তিনশোর বেশি মানুষের আত্মহত্যায় মৃত্যু হয়েছে। এই পরিসংখ্যান উল্লেখ করে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘বাজেটে উল্লেখিত মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি প্রতীকী বলে মনে হচ্ছে। প্রকল্পে কোনও সাম্য নেই। কারণ, টেলি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ডিজিটাইজ়েশনকে মুখ্য করে তোলা হয়েছে। কয়েক কোটি জনসংখ্যার দেশে সকলের সেই ব্যবস্থা নেই। তবে কি ধরে নিতে হবে দরিদ্র মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির প্রয়োজন নেই!’’ দেশের আইনে স্পষ্ট করে জনগোষ্ঠীতে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের কথা বলা থাকলেও, বাজেটে সেটি লঙ্ঘিত হচ্ছে বলেই মনে করছেন রত্নাবলী। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘পাড়ায় পাড়ায় মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে তার দায় কি রাষ্ট্র এড়াতে পারে? আত্মহত্যা সামলানোর পরিকাঠামোয় কোনও বরাদ্দ থাকবে না কেন?’’
অতিমারিতে মানসিক অবসাদের কারণে দেশে আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে সহমত পোষণ করে ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’-র সদ্য-প্রাক্তন অধিকর্তা প্রদীপ সাহা বলেন, ‘‘ডিজিটাল সুবিধা থাকলেও
সকলে যে টেলি মেন্টাল হেলথ পরিষেবা নিচ্ছেন, তেমনটা নয়। কারণ নিজেকে তাঁরা মানসিক রোগী ভাবতে নারাজ। ফলে বহু মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগলেও সব স্তরেই তাঁরা অবহেলিত। সমস্ত রকমের
উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও, শুধু টেলি পরামর্শ দিয়ে কতটা কী হবে, তা বলা মুশকিল।’’ প্রদীপবাবু জানান, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি তখনই সম্ভব, যখন রোগীকে অবজ্ঞা করার মানসিকতা সমাজ থেকে দূর হবে।
২০১৫-’১৬ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষায় জানা গিয়েছিল, জনসংখ্যার প্রতি ৭ জনের মধ্যে এক জনের সমস্যা রয়েছে।
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগের প্রধান চিকিৎসক রঞ্জন ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘এই পরিসংখ্যান হিমশৈলের চূড়া। টেলি মেডিসিনের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা হয়তো ১০-১৫ বছর পরে প্রয়োজন পড়ত। অতিমারি সেটিকে ত্বরান্বিত করেছে।’’
অতিমারি পরিস্থিতি এবং কোভিড সংক্রমিতের পরবর্তী মানসিক অবসাদ অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। প্রদীপবাবু বলছেন, ‘‘এক জন রোগী পরিজনদের কাছে দাবি করতেন, তাঁকে কেন শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না? কারণ তিনি মনে করতেন করোনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’’ এই পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রকম ধাক্কা খাওয়ার প্রমাণ মেলে রাজ্যের স্বাস্থ্য বুলেটিনের পরিসংখ্যান দেখলেই। ২০২০ সালের ১ অগস্ট থেকে রাজ্যে ‘টেলি সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং’ শুরু হয়েছিল। ১ বছর ৬ মাসের (৩০ জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত) মধ্যে সেই পরিষেবা নিয়েছেন ৪ লক্ষ ৮৩ হাজার ৩৮ জন।
রঞ্জনবাবু বলছেন, ‘‘টেলি পরিষেবায় দূরত্ব বা খরচ কমবে এবং ফোনে মন খুলে কথা বলা যাবে, সেটা হয়তো ঠিক। কিন্তু
বিশেষ কয়েকটি ওষুধ ছাড়া সব ওষুধ টেলিমেডিসিনে দেওয়ার নিয়ম নেই। তাই চূড়ান্ত সমস্যা বা আত্মহত্যার প্রবণতা মনের কোণে বাড়তে থাকলে
চিকিৎসকের কাছে যেতেই হবে।’’ তবে রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের দাবি, মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা প্রান্তিক স্তরেও পৌঁছে দিতে ইতিমধ্যেই পদক্ষেপ করা হয়েছে।