একটা অন্য রকম জীবনের হাতছানি। সেই লোভে পা বাড়ালেই অপেক্ষা করছে বিপদ।
ক্রমেই এটা বাড়ছে। কখনও বিজ্ঞাপন দিয়ে, কখনও অন্য ভাবে। তেমনই ফাঁদে পা দিয়ে ঘর ছেড়েছিল কাকদ্বীপের তিন কিশোরী। বরাতজোরে মঙ্গলবার রাতে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে তাদের উদ্ধার করেছেন চাইল্ড লাইনের সদস্যরা। জানা গিয়েছে, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে এসেছিল তারা। ভিত্তি একটা মাত্র ফোন নম্বর।
প্রলোভনে পা দিয়ে বিপদে জড়ানোর তালিকায় এই ঘটনা একটা সংযোজন মাত্র। কিন্তু বাস্তব হল, এ ধরনের বিজ্ঞাপন বা চক্র রোখার কোনও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই বা থাকলেও তা কাজ করে না।
কাকদ্বীপের দক্ষিণ গোবিন্দপুর, রথতলা ও গণেশপুরের ওই তিন কিশোরী মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের। সবে একাদশ শ্রেণিতে উঠেছে। বনভেড়ি অঞ্চলের এক কোচিং সেন্টারে আলাপ থেকে বন্ধুত্ব। ৩০ মে খবরের কাগজে তারা দেখেছিল, ‘কলকাতায় ফাইভ স্টার হোটেল এবং শপিং মলে কাজ করার জন্য কর্মী দরকার। কাজ অনুযায়ী মাসে ১০-১৯ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়। থাকা-খাওয়া নিখরচায়। কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতারও দরকার নেই।’ বিজ্ঞাপনে শুধু একটা ফোন নম্বর দেওয়া ছিল। কাউকে না জানিয়েই ফোন করে ফেলে তিন জন।
ফোন ধরে এক মহিলাকণ্ঠ তাদের ঠিকুজিকুষ্ঠি জেনে নিয়ে বলেছিল, ‘‘ধাপে ধাপে ঠিকানা বলা হবে। সেই মতো চলে এসো। বাড়িতে বলার দরকার নেই। বাবা-মা শুধু শুধু ভয় পাবেন। আসতে দেবেন না। ভাল চাকরি হাতছাড়া হবে।’’ ৩১ মে মঙ্গলবার দুপুরে কাউকে কিছু না বলে ট্রেনে চেপে ডায়মন্ডহারবার স্টেশনে পৌঁছয় তিন জন। বিজ্ঞাপনের নম্বরে ফের ফোন করলে মহিলা কণ্ঠ শিয়ালদহ স্টেশনে যেতে বলে। সেখানে পৌঁছলে ফোনেই নির্দেশ আসে, বিধাননগর স্টেশনে অটো ধরে লেকটাউনের মনসা মন্দিরের কাছে পৌঁছে ফের ফোন করতে।
ততক্ষণে রাত হয়ে গিয়েছে। অচেনা জায়গায় পৌঁছে ভয়ও পেয়েছিল তিন কিশোরী। অগত্যা শিয়ালদহেই চুপচাপ বসে ছিল তারা। ইতিমধ্যে বাড়ির লোক থানায় ডায়েরি করেন। খবর পেয়ে কলকাতা চাইল্ড লাইনের চার কর্মী তাদের খুঁজতে খুঁজতে রাত ১১টা নাগাদ পৌঁছন শিয়ালদহে। চোখে পড়ে, প্ল্যাটফর্মের এক কোনায় বসে তিন জন।
বুধবার ওই কিশোরীদের কলকাতা শিশুকল্যাণ কমিটির সামনে হাজির করা হয়। ছিলেন অভিভাবকেরাও। এক দিন বেসরকারি হোমে রেখে তাদের আজ, বৃহস্পতিবার ফের দক্ষিণ ২৪ পরগনার শিশুকল্যাণ কমিটির সামনে হাজিরার নির্দেশ হয়েছে। কমিটির কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ে তিন কিশোরী জানিয়েছে, নায়িকাদের মতো জীবনের লোভে বাড়িতে না বলে তারা চলে এসেছিল। কলকাতায় কাজ করে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন বুঝছে, তারা খারাপ পাল্লায় পড়ে যেত।
সমাজকল্যাণ দফতরের কর্তাদের আফশোস, ‘‘অবাস্তব স্বপ্ন বাস্তব করার অসম্ভব মরীচিকার পিছনে ছুটতে গিয়ে পা পিছলে যাচ্ছে বয়ঃসন্ধিতে পা দেওয়া অনেক ছেলেমেয়ের।’’ বিজ্ঞাপনের সেই নম্বরে চাইল্ড লাইন থেকে ফোন করতে উল্টো দিকের নারীকণ্ঠ এক বার হ্যালো বলেই এ পারে পুরুষকণ্ঠ শুনে চুপ করে যায়। সেই থেকে ফোনটি বন্ধ!
কলকাতা শিশুকল্যাণ কমিটির প্রধান ইন্দ্রাণী গুহব্রহ্ম বলছিলেন, ‘‘এই ধরনের কেস খুব বেশি পাচ্ছি। বিজ্ঞাপন দেখে বা এক দিন একটা মিসড-কল পেয়ে বা কারও সঙ্গে সামান্য কিছু দিনের পরিচয়ে মেয়েরা ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ছে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা।’’ তাঁর কথায়, ‘‘সকলের এখন যে কোনও মূল্যে দামি পোশাক, বাড়ি, প্রসাধনী, হোটেলে খাওয়া, আরামের জীবন চাই। কতটা আমি পেতে পারি সেই আন্দাজটা কেউ করছে না। এতেই সর্বনাশ হচ্ছে।’’
এ ধরনের বিজ্ঞাপন এবং বিপদ-জাল আটকে দেওয়া যে তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়, তা কার্যত মেনে নিয়েছেন নারী ও সমাজকল্যাণ দফতরের সচিব রোশনি সেন। তাঁর কথায়, ‘‘শাস্তি দেওয়াটা পুলিশের এক্তিয়ার। আমরা মূলত দেখি নিরাপত্তার দিকটা। কিন্তু নিরাপত্তা বলতে আমাদের টাস্ক ফোর্স উদ্ধার হওয়া মেয়েদের বাড়ি ফেরত পাঠায়। তার বেশি কিছু নয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সিআইডির একটা পৃথক সেল এ বিযয়টি দেখে। কিন্তু মুশকিল হলো, অন্য রাজ্যে যেমন উচ্চপদস্থ আইপিএস অফিসারেরা এ ব্যাপারে খুব আন্তরিক ভাবে উদ্যোগী হন, তেমনটা এখানে দেখা যায় না। আমাদের টাস্ক ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো এ নিয়ে বারবার অভিযোগও জানায়।’’
সিআইডি-র ওই নারীপাচার প্রতিরোধ সেলের দায়িত্বে দীর্ঘ দিন থাকা শর্বরী ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘শুধু পুলিশ আর বিচারব্যবস্থা উদ্যোগী হলে হবে না। সচেতন করতে হবে সাধারণ মানুষকেও। পঞ্চায়েত সদস্য ও প্রধানদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুলে উঁচু ক্লাসে ছাত্রীদেরও শেখাতে হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে তারা সচেতন থাকবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy