Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ভারত থেকে বিশ্ব দর্শন, উৎসুক প্রতীক্ষা আমজনতার

বাতাসে শরতের হিমেল আমেজ এখনও তেমন ভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। বিদায় নেয়নি বর্ষাও। মাঝেমধ্যেই আকাশ মুখ ভার করে উপুড় করে দিচ্ছে বৃষ্টির ঝাঁপি। তবে, খামখেয়াল প্রকৃতিকে সঙ্গী করেই পাড়ার মোড়ে, অলিতে-গলিতে বাঁশের কাঠামোটা কিন্তু তৈরি হয়ে গিয়েছে। কুমোরপাড়াতেও শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। প্রতীক্ষা আর মাত্র তিন সপ্তাহের। তার পরেই চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে হই হই করে এসে পড়বেন তিনি। তবে প্রতি বছর এই সময় এসে তিনি মন মাতিয়ে দেন ঠিকই, কিন্তু থাকেন না বেশিক্ষণ। আমবাঙালির অবশ্য তাতে থোড়াই কেয়ার। তাঁদের মন যে চলে বাহির পথে।

বুধাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:০৯
Share: Save:

বাতাসে শরতের হিমেল আমেজ এখনও তেমন ভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। বিদায় নেয়নি বর্ষাও। মাঝেমধ্যেই আকাশ মুখ ভার করে উপুড় করে দিচ্ছে বৃষ্টির ঝাঁপি। তবে, খামখেয়াল প্রকৃতিকে সঙ্গী করেই পাড়ার মোড়ে, অলিতে-গলিতে বাঁশের কাঠামোটা কিন্তু তৈরি হয়ে গিয়েছে। কুমোরপাড়াতেও শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। প্রতীক্ষা আর মাত্র তিন সপ্তাহের। তার পরেই চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে হই হই করে এসে পড়বেন তিনি। তবে প্রতি বছর এই সময় এসে তিনি মন মাতিয়ে দেন ঠিকই, কিন্তু থাকেন না বেশিক্ষণ। আমবাঙালির অবশ্য তাতে থোড়াই কেয়ার। তাঁদের মন যে চলে বাহির পথে।

কিন্তু রোজকার ব্যস্ততা, দায়-দায়িত্ব সামলে সময় বার করা যাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় না, তাঁদের কখনও ইচ্ছে হয় রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রামে যেতে, কখনও তাঁরা ঘুরে আসতে চান ছত্তীশগঢ়ের রাজবাড়ি থেকে। কেউ কেউ আবার ঘণ্টাখানেকের জন্য ঢুঁ মেরে আসতে চান ভিন্ দেশ থেকেও। আর, এত কিছু সম্ভব হয় যাঁদের আনুকূল্যে, তাঁরা এই শহরেরই বিভিন্ন পুজোকমিটি।

যেমন, বড়িশা তরুণ তীর্থ। এ বছর তাঁরা দর্শকদের নিয়ে যাবেন সোনাবাঈ রাজওয়ারের কাছে। ছত্তীশগঢ়ের এক অখ্যাত গ্রামের গৃহবধূ তিনি। দীর্ঘ দিন অত্যাচার সয়ে তাঁর মধ্যে জন্ম নেয় এক জেদ। তিনি ঠিক করেন, তাঁর তৈরি পুতুল তাঁর হয়ে কথা বলবে। সোনাবাঈয়ের সেই অপরূপ সৃষ্টি প্রতিমার হাতে দেখা দেবে অশুভ শক্তি বিনাশকারী অস্ত্র রূপে। আজকের সমাজে চারপাশে যে পাশবিক প্রবৃত্তি, তাকে ধ্বংস করতেই দুর্গার আবির্ভাব ঘটবে। নিজেকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করে তিনি হয়ে উঠবেন জগন্মাতা। বড়িশা তরুণ তীর্থের পুজোমণ্ডপ সাজবে ছত্তীশগঢ়ের একান্ত নিজস্ব লোকনৃত্যের বিভিন্ন মূহূর্তে।

ছত্তীশগঢ় ঘুরে আপনি যেতে পারেন জগন্নাথদেব দর্শনে। বাগমারি রোডের জাজবাগান স্বামী বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাবে হাত ধরাধরি করে থাকবে দুই পড়শি রাজ্য বাংলা এবং ওড়িশা। যদি পুরী ঘোরা না থাকে, কুছ পরোয়া নেই। এই পুজোয় উঠে আসবে জগন্নাথদেবের গোটা মন্দিরটাই। মূল মণ্ডপের প্রায় ১০০ ফুট আগে সিংহদুয়ার দিয়ে প্রবেশ করবেন দর্শকেরা। এক দিকে বিভিন্ন পেন্টিংয়ে ফুটে উঠবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর লীলা, অন্য দিকে জগন্নাথদেবের নানা রূপ। তুলসীমঞ্চ পেরিয়ে মূল মণ্ডপে সাবেক প্রতিমা। মণ্ডপ সাজবে খোল, করতাল, নামাবলীতে। এক হয়ে যাবে বাংলা এবং ওড়িশার সংস্কৃতি।

নাগাল্যান্ড ঘুরতে চাইলে দর্শনার্থীদের যেতে হবে ম্যুর অ্যাভিনিউ পূজা সমিতিতে। উত্তর-পূর্ব ভারতের বাঁশের কারুকাজের কদর সারা বিশ্ব জুড়ে। তা দিয়েই এখানে তৈরি হবে মন্দির। প্রবেশপথের দু’ধারে শতাধিক ধরনের বনসাই। মন্দিরে ডাকের সাজের একচালার প্রতিমা।

ওয়েলিংটনের নাগরিক কল্যাণ কমিটির ভাবনায় উঠে আসবে কেরলের এক টুকরো ছবি। সঙ্গীত এবং মূকাভিনয়ের মিলন হবে সেখানে। মন্দিরের আদলে মণ্ডপ জুড়ে নানা রঙের ম্যুরাল। বাঁশ ও কাঠের কাজে কেরলের লোকনৃত্যের মুহূর্ত। প্রতিমার রূপেও পুরাণের ছাপ। সারা মণ্ডপ জুড়ে থাকবে ফুলের আল্পনা, কেরলে যার নাম পুকালাম। ফুল, আলো, রং সব কিছুর মিশেলে দর্শকদের মোহিত করে রাখবে ২৫ বছরে পা দেওয়া এই পুজো। শোনা যাবে দুর্গার স্তবও।

দক্ষিণ ভারতীয় উৎসবেরই আর এক প্রকাশ উল্টোডাঙা সংগ্রামীর পুজোতেও। জেখতে দেখতে এই পুজো পেরিয়ে এল ৫১ বছর। মূলত ফুল ও মালা দিয়ে কাজ মণ্ডপ জুড়ে, প্রতিমাও দক্ষিণ ভারতীয় ঘরানার।

যাঁরা লোকশিল্প ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য সম্মিলিত মালোপাড়া সর্বজনীন নিয়ে আসছে রাজস্থানের কাবাড শিল্প। মূলত রাজস্থানের রাজপরিবারে প্রচলিত ছিল এই শিল্প। প্রায় ৫৫০ বছরের প্রাচীন, অধুনালুপ্ত এই শিল্পে গল্পের মাধ্যমে ভগবান দেখা দেন ভক্তের দুয়ারে। সম্মিলিত মালোপাড়া সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে নতুন ভাবে ফিরিয়ে আনছেন এই হারানো শিল্পকে। ছোট ছোট মন্দিরে সেজে উঠবে গোটা পূজাপ্রাঙ্গণ। মন্দিরের গায়ে খোদাই করা থাকবে দেবদেবীর কাহিনি। পুরো শিল্পকর্মই কাঠ দিয়ে। বেলেঘাটা প্রগতি সংসদে দুর্গা পূজিত হবেন দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরে। সোনালি সাজে সাবেক প্রতিমা।

দমদম পার্ক সর্বজনীন তাঁদের ৬৩ বছরের পুজোয় আপন করে নেবেন বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে। এই বাংলাই বিশ্বকে উপহার দিয়েছে টেরাকোটা, ডোকরা, পটশিল্পের মনোহারী কাজ। পাশাপাশি, টুসু, ছো, গম্ভীরা, ভাওয়াইয়া প্রভৃতির মাধ্যমে বয়ে চলেছে তাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। দমদম পার্ক সর্বজনীনের মণ্ডপসজ্জাতেও তাই থাকছে ডালের বড়ি, পাট, শুকনো ফল, বেত ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব সামগ্রীর ব্যবহার। দর্শকেরা দেখতে পাবেন পুতুলনাচ, শুনবেন কবিগান ও লোকগীতি। এক সুরে বাঁধা পড়বে শিল্পকলা ও আধ্যাত্মিকতা।

দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে পা রাখতে চান? পুজোর শহরে সেই ব্যবস্থাও থাকছে। গড়িয়া-বৈষ্ণবঘাটার যাত্রা শুরু সঙ্ঘ আপনাকে নিয়ে যাবে তাইল্যান্ড দর্শনে। নানা রঙের ব্যবহার এবং অলঙ্করণে সে দেশের মন্দির হয়ে ওঠে অনন্য। যাত্রা শুরু সঙ্ঘে দেখা যাবে সেই অপরূপ শিল্পসুষমার ঝলক।

বি কে পাল অ্যাভিনিউয়ের সন্ধানীর পুজোয় উঠে আসবে বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের একটি মিশরের পিরামিড। দর্শকেরা ঢুকবেন গুহার মধ্যে দিয়ে। মণ্ডপের সামনে ফারাওয়ের মূর্তি। ভিতরে আলো-আঁধারির খেলা। সব মিলিয়ে এই পুজো দর্শকদের পরিচয় করাবে এক অন্য জগতের সঙ্গে।

বাগুইআটির ইউনাইটেড ক্লাব তাঁদের ৬১ বছরে তুলে আনবেন মায়ানমারের ‘বোট ফেস্টিভ্যাল’। গৌতম বুদ্ধের শান্ত, সমাহিত রূপের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে প্রতিমারও এখানে স্নিগ্ধ রূপ। শিল্পী সুতনু মাইতি নানা রঙে ভরিয়ে তুলবেন মণ্ডপ। গার্ডেনরিচের দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ে সর্বজনীন দুর্গাপূজা সমিতিতে গেলে ঘুরে আসা যাবে কাম্বোডিয়া থেকে। সেখানকার সিলভার প্যাগোডার আদলে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। মণ্ডপসজ্জায় থাকছে গয়নার ব্যবহার। চারপাশের হিংসা-হানাহানির পরিবেশে দাঁড়িয়ে এই পুজো দেবে শান্তির বাণী। শান্তির দূত হিসেবে দেখা দেবেন উমা।

প্রদীপ সঙ্ঘ নতুনপল্লি অধিবাসীবৃন্দের সৃজনে আফ্রিকার মাসাই উপজাতির জীবন যাপন। ভৌগোলিক দূরত্ব যতই হোক না কেন, এই পুজোয় থাকবে ভারত-আফ্রিকার সংস্কৃতির মেলবন্ধন। সাবেক প্রতিমার সাজেও মাসাই শিল্পের ছোঁয়া।

ভাবছেন কোথায় যাবেন?

আর দেরি নয়। হাতে সময় মাত্র চারটে দিন। ভারত এবং বিশ্ব দু’টো ভ্রমণই কিন্তু তার মধ্যে সেরে ফেলতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE