Advertisement
২১ মে ২০২৪
শাসকের আশীর্বাদেই চোখে ঠুলি

কোর্টের নির্দেশ না-মেনে কাঠগড়ায় পুলিশ, পুরসভা

পোস্তা এলাকায় দুষ্কৃতী গোপাল তিওয়ারির বাড়বাড়ন্ত দেখেও নড়েচড়ে বসেনি লালবাজার। যার নিটফল, পুরভোটে গুলিবিদ্ধ হতে হয়েছিল এক পুলিশকর্মীকেই। দেশপ্রিয় পার্কে সবার চোখের সামনেই তৈরি হচ্ছিল ৮৮ ফুটের বিশাল মণ্ডপ। দেশ জুড়ে দেওয়া হয়েছিল ঢাউস বিজ্ঞাপন।

তবু ভাটা পড়েনি উৎসাহে...। দেশপ্রিয় পার্কে স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

তবু ভাটা পড়েনি উৎসাহে...। দেশপ্রিয় পার্কে স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:০৩
Share: Save:

পোস্তা এলাকায় দুষ্কৃতী গোপাল তিওয়ারির বাড়বাড়ন্ত দেখেও নড়েচড়ে বসেনি লালবাজার। যার নিটফল, পুরভোটে গুলিবিদ্ধ হতে হয়েছিল এক পুলিশকর্মীকেই।

দেশপ্রিয় পার্কে সবার চোখের সামনেই তৈরি হচ্ছিল ৮৮ ফুটের বিশাল মণ্ডপ। দেশ জুড়ে দেওয়া হয়েছিল ঢাউস বিজ্ঞাপন। নবান্ন থেকে পুরসভা বা লালবাজার, কেউই গা করেনি। প্রশাসনের পরোক্ষ প্রশ্রয়েই পোস্তার গোপাল তিওয়ারির মতোই দিনে দিনে বড় হয়েছে দেশপ্রিয় পার্কের মণ্ডপ।

গুলি চালানোর ঘটনার পরে পুলিশ এক রকম বাধ্য হয়েই গোপালকে গ্রেফতার করেছিল। তাকে বাড়তে না-দিলে এক পুলিশ অফিসারকে যে গুলি খেতে হতো না, তা ঠারেঠোরে স্বীকার করেছে লালবাজারের একটি অংশ।

রবিবার দর্শনার্থীর চাপে পুলিশের সব প্রতিরোধ ভেঙে যাওয়ার পর ‘সব থেকে বড় দুর্গা’-কে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে লালবাজার। সোমবার প্রথমে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় প্যান্ডেল। পরে কাপড় সরালেও রাস্তা থেকে যাতে প্যান্ডেল দেখতে পাওয়া না-যায়, সে জন্য বড় বড় ব্যানার দিয়ে আড়াল করে দেওয়া হয়। মাঠের ভিতরেও জনসাধারণের ঢোকা নিষেধ। নিয়ম ভাঙার অভিযোগও দায়ের হয়েছে পুজো কমিটির বিরুদ্ধে। কিন্তু লালবাজারের অনেকেই বলছেন, আগে নড়েচড়ে বসলে পুলিশের এ ভাবে নাক কাটা যেত না। নগরপালকেও মেট্রো চেপে ছুটতে হতো না ঘটনাস্থলে।

দেশপ্রিয় পার্কের ক্ষেত্রে আইন ভাঙা হয়েছে কী ভাবে?

কলকাতার পুজো কমিটির কর্তারা জানাচ্ছেন, পুজোর অনুমতি নিতে এখন এক জানলা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বরোতে গিয়ে নির্দিষ্ট ফর্মে আবেদন করতে হয়। প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়ার সময় পুলিশ ফর্মে লিখে দেয় যে, পুজোটি পুরনো এবং আগের বছর যা মাপ ছিল, তার চেয়ে বড় প্যান্ডেল করা হবে না। এই অনুমোদন দেখে পুজোর প্রাথমিক অনুমতি দেয় দমকল। অন্য দিকে, মণ্ডপের উচ্চতা কখনওই ৪০ ফুটের উপরে হবে না, এমন অঙ্গীকার করা হলে তবেই অনুমতি দেয় পুরসভা। সেই অনুমতির ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য অগ্রিম টাকা নেয় সিইএসসি। এক পুজো-কর্তার কথায়, ‘‘৪০ ফুটের বেশি প্যান্ডেল হবে না, এই প্রাথমিক শর্তটাই মানেনি দেশপ্রিয় পার্ক। তার পরেও পুলিশ-পুরসভা কিছু বলেনি। সিইএসসি-ও বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছে।’’

প্যান্ডেল তৈরি হওয়ার সময়েই পুলিশ ও দমকলের একাধিক বার তা পরিদর্শন করার কথা। তখন তারা আপত্তি করল না কেন? এখানেই মিলছে রাজনীতির গন্ধ! কলকাতা পুলিশের এক প্রবীণ অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের মন্তব্য, ‘‘গোপাল তিওয়ারির সঙ্গে বড়বাজারের এক তৃণমূল নেতার দহরম মহরম এখন আর গোপন নেই। দেশপ্রিয় পার্ক পুজো কমিটিতেও শাসক দলেরই দাপট।’’ কলকাতা পুরসভার এক মেয়র পারিষদের ভাই পুজো কমিটির সম্পাদক। দু’বছর আগে পর্যন্ত পুজো কমিটির মাথায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে রাজনীতির যোগ তেমন ছিল না। রাজ্যে পালাবদলের পরে কমিটির দখল নেয় তৃণমূল।

শহরের আর একটি বড় পুজো সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের অন্যতম কর্তা, একদা তৃণমূল পরিচালিত পুরসভার মেয়র পারিষদ, অধুনা বিজেপি নেতা প্রদীপ ঘোষ এ দিন বলেন, ‘‘আমাদের পুজোর প্যান্ডেল নিয়ম মেনে হচ্ছে কি না, তা দেখতে তো পুলিশ ও দমকলের লোকেরা আট বার এসেছে। একটু এ-দিক ও-দিক দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে তা বদল করার নির্দেশ দিয়েছে। নইলে পুজোর অনুমতি বাতিল করার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।’’ দেশপ্রিয় পার্কের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হল না কেন? প্রদীপবাবুর কথায়, ‘‘ওটা তো শাসক দলের পুজো। তাই পুলিশ ও দমকলের মুখ বন্ধ।’’

২০০৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ জারি করে বলেছিলেন, প্রয়োজনে পুলিশ মণ্ডপের আকার-উচ্চতা বদলাতে পারে। এমনকী মণ্ডপের বেআইনি অংশ ভেঙেও দিতে পারে। পুজো উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতাও পুলিশের রয়েছে। ওই নির্দেশে রাজ্য সরকারের একটি হলফনামারও উল্লেখ রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, হাইকোর্টের নির্দেশ পালিত না-হলে রাজ্য সরকার তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেবে। হাইকোর্টের এক আইনজীবীর মন্তব্য, দেশপ্রিয় পার্ক নিয়ে মামলা হলে আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে পারে রাজ্য।

হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে পুজো হচ্ছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব পুলিশেরই। তা হলে এত দিন পুলিশ কী করছিল? পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থের বক্তব্য, ‘‘যখনই সমস্যাটা আমাদের নজরে এসেছে, তখনই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’ কিন্তু সবার সামনে চার মাথার মোড় লাগোয়া পার্কে মাস তিনেক ধরে মণ্ডপ তৈরি হল, আর পুলিশ জানতে পারল না? পুলিশ কমিশনারের ব্যাখ্যা, ‘‘নজরে এসেছে দেরিতে। নজরে আসার পরেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’ অন্য সব মণ্ডপে লালবাজারের কর্তারা, এমন কী পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত পরিদর্শনে গিয়েছেন। কিন্তু দেশপ্রিয় পার্কে তাঁরা কেউ যাননি। এই পুজোর মাথায় শাসক দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের একাংশের হাত রয়েছে বলেই কি পুলিশ এমন গুটিয়ে থেকেছে? এর জবাব না-দিয়েই সাংবাদিক বৈঠক ছেড়ে উঠে পড়েন পুলিশ কমিশনার।

কলকাতার এক পুজো-কর্তা জানাচ্ছেন, উৎসব শুরু হওয়ার প্রায় দু’মাস আগে থেকেই পুজো কমিটিগুলির সঙ্গে বৈঠক শুরু করে পুলিশ-প্রশাসন। থানা স্তর থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় স্তরেও বৈঠক হয়। ‘‘বারবার বৈঠক করার পরেও যদি উৎসব শুরুর প্রাক্ মুহূর্তে পুজো বন্ধ করে দিতে হয়, তা হলে এত সমন্বয় বৈঠকের অর্থ কী,’’ প্রশ্ন তুলেছেন অন্য এক পুজো-কর্তা। উত্তর কলকাতার এক পুজো-কর্তার মন্তব্য, ‘‘দেশপ্রিয় পার্কের কমিটি নিয়ম না-মেনে যদি অন্যায় করে থাকে, তা হলে পুলিশও গাফিলতির দায় এড়াতে পারে না।’’ সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তাদের কেন শাস্তি হবে না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন পুজোর উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ। তাঁরা সকলেই অবশ্য শাসক দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা। পুলিশ কমিশনার অবশ্য বলছেন, ‘‘পুজোর কর্তাদেরও দায়িত্ব থাকে।’’ পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমেরও মন্তব্য, ‘‘ভুল পরিকল্পনার কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে। তবে সব দোষ পুলিশের ঘাড়ে দিলে চলবে না। উদ্যোক্তাদেরও তো দায়িত্ব আছে।’’

পুজো উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, শহরের আরও কয়েকটি মণ্ডপ হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে তৈরি হয়েছে। শাসক দলের নেতারা জড়িত থাকায় সেই সব মণ্ডপ ভাঙা হয়নি। পুলিশ কমিশনার এ প্রশ্নেরও কোনও জবাব দেননি। তবে তিনি বলেন, ‘‘ওই মণ্ডপে যে এত ভিড় হবে, তা আমরা আন্দাজ করতে পারিনি। কেন এটা বোঝা গেল না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’’

দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান অবশ্য তাঁর দফতরের গাফিলতির কথা মানতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘বারবার বলা সত্ত্বেও আমাদের নির্দেশিকা ওরা মানেনি। না মানলে কী করব?’’ সে ক্ষেত্রে থানায় অভিযোগ করা হয়নি কেন? জাভেদ প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। দেরিতে হলেও সোমবার পুলিশ থানায় পুজোর কমিটির বিরুদ্ধে নিয়ম না-মানার অভিযোগ করেছে। দমকল এখনও তা করে উঠতে পারল না কেন? জবাব মেলেনি সেই প্রশ্নেরও।

দেশপ্রিয় পার্ক পুজো কমিটির কর্তাদের অনেকেই অবশ্য নিজেদের গাফিলতি মানতে নারাজ। বরং পুলিশ পুজো বন্ধ করে দেওয়ায় তাঁদের যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে তার বিবরণ দিতে ব্যস্ত তাঁরা। পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যে লোকসান হল, তার অনেকটাই এখন তাঁদের বহন করতে হবে বলে জানাচ্ছেন অন্যতম কর্তা সুদীপ্ত কুমার। পুজো শেষে পুলিশ কী আইনি ব্যবস্থা নেবে তা নয়, পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ক্ষতি পূরণই আপাতত তাঁদের মাথাব্যথা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE