Advertisement
০৩ মে ২০২৪

ছাপানো বিলে ‘পাওনা’ আদায় হিজড়েদের

অনেকটা পাড়ার পুজোর চাঁদার বিল বা ক্লাবের অনুষ্ঠানের ‘স্পনসরশিপ ফর্মে’র মতো। তাতে লেখা, প্রাচীন পরম্পরার কথা। সেই প্রথাটিকে ঢাল করে জবরদস্তি টাকা আদায়ের পরে এমন ‘বিল’ রেখে আসাটাও ইদানীং দস্তুর হয়ে উঠেছে।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৪ ০৫:১২
Share: Save:

অনেকটা পাড়ার পুজোর চাঁদার বিল বা ক্লাবের অনুষ্ঠানের ‘স্পনসরশিপ ফর্মে’র মতো। তাতে লেখা, প্রাচীন পরম্পরার কথা। সেই প্রথাটিকে ঢাল করে জবরদস্তি টাকা আদায়ের পরে এমন ‘বিল’ রেখে আসাটাও ইদানীং দস্তুর হয়ে উঠেছে।

গোটা কলকাতা জুড়েই এমন অভিযোগ উঠছে। সই করা ছাপানো বিল ছাড়াও কখনও দেখা যাচ্ছে, সচিত্র কার্ড। ইচ্ছে মতো টাকা আদায় করে ‘রসিদ’ হিসেবে সেই কার্ড রেখেই গৃহস্থের চৌকাঠ ছাড়ছেন অভিযুক্তেরা। যাঁরা টাকা নিয়ে গেলেন, কার্ডে তাঁদের নাম কিংবা সমিতির নাম-ঠিকানা। অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ সব জেনেশুনেও এক পা এগোতে সাহস পাচ্ছে না।

অভিযুক্তেরা তথাকথিত হিজড়ে সমাজভুক্ত। বাড়ি ঢুকে নাচ-গান করে নবজাতককে হিজড়েদের আশীর্বাদের পরম্পরা যুগ যুগ ধরে চললেও এই ‘আশীর্বাদে’র বিনিময়ে জবরদস্তি ‘পাওনা’ আদায়ের পরিমাণটা ক্রমশ বাড়ছে। বিয়ের অনুষ্ঠানের পরেও ঘটছে হিজড়ের আবির্ভাব। অভিযোগ, হিজড়েদের প্রাপ্য টাকার অঙ্ক, চার-পাঁচ হাজার থেকে ৫০ হাজারও ছুঁয়েছে।

হিজড়েদের কয়েকটি গোষ্ঠীর মুখপাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা অবশ্য জবরদস্তির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আলিপুর হিজড়া অ্যাসোসিয়েশনের কার্ডে লেখা একটি নম্বরে যোগাযোগ করলে সঙ্গীতা নাম বলে এক জন কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য, “আমরা হাতে-পায়ে ধরে দু’-পাঁচশো টাকা বাড়িয়ে নিই! বারুইপুরের লতামাসিও তাই বলছেন। কিন্তু হিজড়ে পরিচয়ে যাঁরা ঘোরাঘুরি করছেন, তাঁদের সবার উপরে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা যে তাঁদের নেই এ কথাও এই হিজড়ে সমাজভুক্তরা মানছেন। তাঁদের বক্তব্য, তাই জবরদস্তির ঘটনাও ঘটছে।

যেমনটি ঘটে বেহালার শীলপাড়ার এক দম্পতির ক্ষেত্রে। কলকাতা পুলিশের ওয়েবসাইটে কমিশনারকে বিষয়টি জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, সন্তানলাভের পরে তাঁদের বাড়িতে ঢুকে হিজড়েরা ৩০ হাজার টাকার দাবিতে ‘তাণ্ডব’ শুরু করে দেন। বাড়ির মহিলাদের ধাক্কাধাক্কি, ভাঙচুর চলে। বলে-কয়ে রফা হয় ১০ হাজার টাকায়। সেই টাকা নিয়ে ‘আলিপুর হিজড়া অ্যাসোসিয়েশনে’র নামে একটি রসিদ দিয়ে যায় অভিযুক্তেরা। ওই দম্পতির অভিযোগ, হরিদেবপুর থানার পুলিশকে রসিদ দেখালেও তারা অভিযোগ লেখেনি। গত সেপ্টেম্বরে লালবাজারের ওয়েবসাইটে অভিযোগ জানালেও সাড়া মেলেনি।

শিশুটির মায়ের বক্তব্য, “যা ঘটেছিল, ভাবলে রাতে ঘুমোতে পারি না!” মাসখানেক আগে চেতলার এক বয়স্ক মহিলা বাড়িতে একা থাকাকালীনও একই রকম বিভীষিকার মুখোমুখি হন।

নাগরিকদের একাংশের অভিজ্ঞতা বলছে, জানতে পেরে মাঝেমধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করলেও পারতপক্ষে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে না পুলিশ। বেশ কিছু ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যেও কাজ করে ভয় ও বিভ্রান্তি। চাপের মুখে টাকা দিলেও মুখ বুজে থাকাই স্বস্তির বলে মনে করেন তাঁরা। গড়িয়াহাট, বেহালা, বাগুইআটিতে এমন ঘটনা ভুরি ভুরি।

লালবাজারের শীর্ষস্তরেও এই সমস্যাটির কথা স্বীকার করা হচ্ছে। পুলিশ বা আইনজ্ঞেরা এক মত, হিজড়েদের টাকা তোলার কাজটা তোলাবাজির নামান্তর। লালবাজারের এক কর্তার কথায়, “এমন জুলুমের ক্ষেত্রে তোলাবাজি, ভয় দেখানো ও অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির জন্য নির্দিষ্ট আইনেই মামলা রুজু করা সম্ভব। বাস্তবে কিন্তু হিজড়েরা বিল ধরিয়ে ‘পাওনা’ আদায়কে এক ধরনের বৈধতা দেওয়ারই চেষ্টা করছেন। তবে এ বিষয়ে হিজড়েদের কারও কারও মত, একই বাড়িতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর হিজড়েরা যাতে চড়াও না হন, সেই জন্যই বিল দেওয়া হয়। তা ছাড়া, হিজড়ের ভেক ধরে টাকা আদায়ের অভিযোগ নিয়েও হিজড়েরাই উদ্বিগ্ন।

কলেজশিক্ষক তথা ‘রূপান্তরিত নারী’ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করাচ্ছেন, “হিজড়েদের আত্মিক সঙ্কটটা বুঝে পুনর্বাসনও জরুরি।” সমাজকল্যাণ দফতরের সচিব রোশনী সেনের বক্তব্য, “হিজড়েদের সঙ্গে কথা বলেই সমাধান খুঁজতে হবে।” কিন্তু এখনও অবধি সেটা সম্ভব হয়নি।

হিজড়েদের পুলিশ ধরলে পুরুষ না মহিলা--- কাদের লক-আপে রাখা হবে থেকে কোন হোমে তাঁদের ঠাঁই হবে, এ-সব নিয়েও নানা বিভ্রান্তি। সরকারি কর্তারা মানছেন, তথাকথিত হিজড়েদের শিক্ষিত, স্বনির্ভর করে মূলস্রোতে আনতে নির্দিষ্ট নীতি থাকা চাই।

রোশনীদেবীর কথায়, “মহারাষ্ট্র এ কাজে কিছুটা এগিয়েছে। আমরা ওঁদের সঙ্গে কথা বলছি। এ রাজ্যেও এখনই কিছু করাটা দরকার।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

riju basu hijre bill
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE