Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

পাল্টে যাচ্ছে রথের মেলা, হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য

“...কলিকাতায় কিছু ফাঁক যাবার নয়; রথের দিন চিৎপুর রোড লোকারণ্য হয়ে উঠ্লো, ছোট ছোট ছেলেরা বার্নিসকরা জুতো ও সেপাইপেড়ে ঢাকাই ধুতি পরে, কোমরে রুমাল বেঁধে, চুল ফিরিয়ে, চাকর চাকরাণীদের হাত ধরে, পয়নালার ওপর পোদ্দারের দোকানে ও বাজারের বারাণ্ডায় রথ দেখতে দাঁড়িয়েচে।...মাটির জগন্নাথ, কাঁঠাল, তালপাতের ভেঁপু, পাখা ও সোলার পাখি বেধড়ক বিক্রি হচ্চে...।” সে যুগে রথযাত্রা প্রসঙ্গে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় এমনটাই লিখেছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ।

বদলাচ্ছে ছবিটা।—নিজস্ব চিত্র।

বদলাচ্ছে ছবিটা।—নিজস্ব চিত্র।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৪ ০০:৪৪
Share: Save:

“...কলিকাতায় কিছু ফাঁক যাবার নয়; রথের দিন চিৎপুর রোড লোকারণ্য হয়ে উঠ্লো, ছোট ছোট ছেলেরা বার্নিসকরা জুতো ও সেপাইপেড়ে ঢাকাই ধুতি পরে, কোমরে রুমাল বেঁধে, চুল ফিরিয়ে, চাকর চাকরাণীদের হাত ধরে, পয়নালার ওপর পোদ্দারের দোকানে ও বাজারের বারাণ্ডায় রথ দেখতে দাঁড়িয়েচে।...মাটির জগন্নাথ, কাঁঠাল, তালপাতের ভেঁপু, পাখা ও সোলার পাখি বেধড়ক বিক্রি হচ্চে...।” সে যুগে রথযাত্রা প্রসঙ্গে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় এমনটাই লিখেছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ।

রথ আছে। মেলাও আছে। কিন্তু বদলেছে মেলার চরিত্র। বিদায় নিয়েছে তালপাতের ভেঁপু, শোলার পাখি, হাতপাখা। নেই কাঠের নাগোরদোলা, তালপাতার সেপাই, কাগজের কুমির, কাচের পাখি, চোরবাগানের লাট্টু। পাঁপড় ভাজা মেলে অতি কষ্টে। সব মিলিয়ে পাল্টেছে পরিচিত ছবি।

মধ্য কলকাতার মৌলালির রথের মেলা ছিল অন্যতম। এখন মেলা হয় রামলীলা ময়দানে। আজও আসেন বহু মানুষ। পরিচিত জিনিসগুলি না পেয়ে ফিরেও যান। যেমন, স্থানীয় বাসিন্দা শৌভিক ঘোষাল বললেন, “এসেছিলাম ধামা ও ঝুড়ি কিনতে। পেলাম না।” দেদার বিকোচ্ছে সস্তার প্লাস্টিকের সরঞ্জাম থেকে শুরু করে চিনে তৈরি কাপ-ডিশ, বাসনপত্র। আর আছে নকল গয়না থেকে সস্তা খেলনার দোকান।

কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল এবং অতি পরিচিত মাটির জগন্নাথের জায়গা নিয়েছে চিনে তৈরি রবারের দেব-দেবীর মূর্তি। দত্তপুকুর থেকে আসা পুতুল ব্যবসায়ী চিত্তরঞ্জন সাহা বললেন, “এখন মাটির পুতুলের চেয়ে এগুলির চাহিদাই বেশি।” গত ১৫ বছর ধরে এই মেলায় আসছেন লোহার জিনিসের ব্যবসায়ী নির্মল কর্মকার। তিনি বলেন, “ভাল জিনিস আনলেও দাম বেশি বলে বিক্রি হয় না। বসিরহাটের ভাল বঁটির দাম পড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। ক্রেতারা ৫০ টাকার বেশি উঠতে চান না।”

আগেই বিদায় নিয়েছে কাঠের নাগোরদোলা। ভিড় জমছে ইলেকট্রিক নাগরদোলা, টয়ট্রেনের সামনে। মেলার বাইরে রঙিন মাছ ও পাখির দোকানে কচিকাঁচাদের ভিড় থাকলেও, ব্যবসায়ীরা জানান আগের মতো বেচাকেনা হয় না। পাঁপড় ভাজার দোকান মাত্র দু’টি। একটি দোকানের মালিক চন্দন পাসোয়ান জানান, বিক্রি অনেক কমেছে।

শহরের অন্য রথের মেলাগুলির ছবিও একই রকম। যেমন, মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মার্বেল প্যালেসের রথের মেলায়ও পরিবর্তন স্পষ্ট। পরিবারের হীরেন্দ্র মল্লিকের কথায়: “ভেঁপুর বাশি, শোভাবাজার ও চিৎপুরের পোশাকে জগন্নাথের মূর্তি, চোরবাগানের লাট্টু, চিৎপুরের মখমলের কাজ করা কোঁচানো পর্দা কোথায়? হারিয়ে যাচ্ছে মাটির পুতুলও। মিলবে প্লাস্টিকের খেলনা, চিনে তৈরি বাসনপত্র। পাঁপড় ভাজার পরিবর্তে এখন ছোটদের হাতে দেখা যায় চিপ্সের প্যাকেট। কোথায় গেল পালেদের তৈরি হলুদ দেওয়া ফুলুরি! রথের মেলার সেই আনন্দই আজ নেই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bibhutisundar bhattacharya rath fare heritage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE