পুজোর সময়ে মমতাদির অনুরোধে দক্ষিণ কলকাতায় মমতার পাঠানো তালিকা অনুযায়ী অন্তত ১০টি পুজোকে বিপুল সাহায্য করেছিলেন সুদীপ্ত। জঙ্গলমহলে প্রচুর অ্যাম্বুল্যান্স দেন সুদীপ্ত। মহাকরণের সামনে স্বেচ্ছায় উদ্বোধন করান মমতা। টু-হুইলারও। কেন প্রশাসন সতর্ক করেনি? সেগুলি তো কার্যত রাজ্য সরকারকেই উৎসর্গ করেছিলেন সুদীপ্ত।
২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে সারদা মিডিয়া পুরোটাই তৃণমূলের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। খবরের বাইরের কিছু বিষয়ে রজত মজুমদারের মাধ্যমে মুকুল রায়ের সঙ্গে/মদন মিত্রের সঙ্গে সেনের যোগাযোগ ছিল বলে আমার স্পষ্ট অনুমান। সেনের কথাতেই বুঝেছি। সেটা সম্ভবত আর্থিক বিষয়েই ছিল। প্রার্থীদের বিপুল টাকা নগদে দিয়েছিল তৃণমূল নেতৃত্ব।
২০১৩ ফেব্রুয়ারি-মার্চ যখন কোনও একটা বিপদ আন্দাজ করেছি তখন মমতা-মুকুল-মদনকে জানিয়ে হস্তক্ষেপ চেয়েছি। কারণ, এঁদের কথা সুদীপ্ত শুনতেন। মমতা একবার ফোনে কথা বলেন। সব স্বাভাবিক। মুকুল প্রথমে ভাব দেখিয়েছেন, গোটাটা তাঁর হাতের মুঠোয়। পাঁচ মিনিটে ঠিক হয়ে যাবে। মদন বলেছিলেন, উদ্বেগের কিছু নেই। সেনের সঙ্গে কথা বলে নেবেন।
সম্ভবত, ৪ এপ্রিল ২০১৩ মমতা বেঙ্গালুরু যান মান্না দে-র কাছে। আমার যাওয়ার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে যাইনি। বিমানবন্দর যাওয়ার পথে মমতা ফোন করেন। আমি পেশাগত সমস্যাটা আবার বোঝাই। বিপদের কথা বলি। উনি সম্ভবত মুকুলকে কোনও বৈঠকের কথা বলে যান।
সারদা যদি খারাপ/মানি মার্কেট/পঞ্জি স্কিম/ এটা মমতাদি/রাজ্য সরকার/পুলিশ/অর্থ দফতর বলেনি কেন? মুখ্যমন্ত্রীকে সারদার অনুষ্ঠানে দেখেও কেন সতর্ক করেনি পুলিশ? মুখ্যমন্ত্রী কেন আমাকে/আমাদের বলেননি?
শুনেছি, ফেব্রুয়ারি ২০১৩ কেন্দ্রের কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রক রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়ে সারদা-সহ কিছু সংস্থার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিল। এটা সত্যি হলে রাজ্য ব্যবস্থা নেয়নি কেন? কেন আমাদের জানায়নি? নাকি সে সময়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্যন্ত সারদা মিডিয়ার সমর্থন নেওয়াটা বেশি জরুরি ছিল?
শুধু সারদা নয়, একাধিক মানি মার্কেট কোম্পানির সঙ্গে মমতা/তৃণমূল নেতৃত্বের যোগাযোগ। অ্যালকেমিস্টের মালিক কে ডি সিংহ দলের সাংসদ। রোজ ভ্যালির গৌতম কুণ্ডুর সঙ্গে কালিম্পংয়ে বৈঠকে নিয়মিত যোগাযোগ। মুকুলের সঙ্গে বৈঠক। সারদা পতনের পরে মমতাদি আমাকে নিজে বলেছিলেন, চক্র গ্রুপের একদিন পত্রিকার দায়িত্ব নিতে। আমি আগ্রহী ছিলাম না।
আমি তো পেশাদার মিডিয়া কর্মী হিসেবে সারদা মিডিয়ায় যুক্ত। সেন আমার কাছে মালিক ও বিজ্ঞাপনদাতা। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর সঙ্গে সেনের চুক্তি সূত্রে আমার যুক্ত হওয়া। কাগজে/টিভি-তে প্রকাশ্যে ছিলাম। আয়কর দিয়েছি। কিন্তু নেত্রী কি জানতেন না, সারদা খারাপ? বলেননি কেন?
সারদা পতনের পরে আর মিডিয়াগুলোর দখল নেওয়ার কাজ কেন করল তৃণমূল? কে চালাল? কোন স্বার্থে? এত দিন আমার কাঁধে বন্দুক রেখে এ বার সরাসরি দখল? তার মানে কতটা নির্ভরতা ছিল? অন্য কোনও বন্ধু সংস্থার কর্মীদের জন্য তো সরকার বা তৃণমূলবান্ধব ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসেন না? মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে টাকা বেরোয় না?
সারদার টাকা ফেরত দিতে সরকারি অতিআগ্রহ কি তাদের নিজেদের ‘প্রায়শ্চিত্তমূলক’ মনোভাবের প্রকাশ নয়?
মমতা কি জানতেন না, নিজাম প্যালেসে মুকুল-সুদীপ্ত বৈঠক? পর দিন দূত রজত মজুমদার সল্টলেক অফিসে গিয়ে সেনের সঙ্গে বৈঠক করলেন। একটি ব্যাঙ্কড্রাফ্ট দিয়ে ‘কলম’ কাগজ হাতবদলের কথা হল। আরও কিছু কথা। তার পরই সুদীপ্তর অজ্ঞাতবাস। এর পর ১৮ এপ্রিল ২০১৩, দিল্লিতে মুকুলের বাড়ি। মুকুল/রজত/কে ডি সিংহ/আসিফ খান বৈঠক। বিষয়: সারদা। সে দিনই সিবিআই-কে চিঠির কপি সংবাদমাধ্যমকে দিলেন মুকুল। গোটাটাই রহস্য।
মমতা জানতেন না, মদন মিত্র সুদীপ্ত-ঘনিষ্ঠ? আমি জীবনে কখনও কোনও এজেন্ট সম্মেলনে যাইনি। মদন নেতাজি ইন্ডোরে সুদীপ্তকে পাশে নিয়ে প্রশংসা করলেন সারদার। এতে এজেন্টরা উৎসাহ পেল না? টাকা তুলতে নামল না? সারদার সব অফিসে মদনের নাম কর্মী ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে থাকত। মদনের অনুরোধে সেই আত্মঘাতী আইনজীবী পিয়ালীকে টাকা দিতেন সুদীপ্ত। কেন, পুলিশ/দল ব্যবস্থা নিল না? মদনের জন্য বর্ধমান কাঞ্চন মেলা প্রোগ্রাম করতে হয়েছিল। এ রকম বহু।
কলকাতার পুলিশ কমিশনার মমতার স্নেহের সুরজিৎ (করপুরকায়স্থ) কেন সারদা সম্মেলনে সুদীপ্তকে পাশে নিয়ে সারদার প্রশংসায়? কেন এজেন্ট/কর্মীদের উৎসাহিত করলেন? কেন সারদার বাড়বাড়ন্তের দায় এঁরও নয়? প্রথমত, এঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হবে না কেন? দ্বিতীয়ত, এঁদের পুলিশ আসল ঘটনার কতটা নিরপেক্ষ তদন্ত করবে?
প্রাক্তন আইপিএস রজত মজুমদার মমতা/মুকুলের আস্থাভাজন। দলের কাছের লোক। সারদায় চাকরি করতেন। মিডিয়ায় নয়, অন্য জায়গায়। লাস ভেগাসে সারদা স্পনসরশিপের উদ্যোক্তা। পরে চাকরি ছাড়েন। কিন্তু সেনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। প্রকাশ্যে ছাড়লেন কেন? খারাপ কিছু মনে হলে পুলিশকে বলেননি কেন? সুদীপ্ত উধাও হওয়ার আগে মুকুলের দূত (মমতারও) হিসেবে উনিই শেষ ব্যক্তি যে সেনকে মিলিত হন। ড্রাফ্ট নিয়ে গেলেন ব্যাঙ্কে। নানা আলোচনা হল, সবই মমতার অজানা? একা মুকুলের সিদ্ধান্ত? সুদীপ্তকে সিবিআই-কে চিঠি লিখে পালানোর চিত্রনাট্য কে/কারা করে দিল?
আরও নানা ঘটনা। একসঙ্গে মনে পড়া কঠিন।
মমতাদি/তৃণমূল সারদার সুবিধা নেয়নি? হাতে করে টাকা নেওয়ার কথা বলছি না। কিন্তু, আর কিছু না হোক, প্রবল চাপ দিয়ে গোটা মিডিয়া শাখাটা পক্ষে রাখা মানেই তো গোটা লগ্নিটার সুবিধা নেওয়া— প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ।
(বানান অপরিবর্তিত)