Advertisement
E-Paper

নেতা-স্বার্থেই সারদায় কোপ, দাবি কুণালের

তৃণমূল ঘনিষ্ঠ এক নেতার অর্থলগ্নি সংস্থাকে আরও প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই সুদীপ্ত সেনের সংস্থা সারদা-কে বিপাকে ফেলা হয়েছিল বলে অভিযোগ এনেছেন তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ কুণাল ঘোষ। দমদম সেন্ট্রাল জেল থেকে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর অফিসে গোপনে একটি চিঠি পাঠান কুণাল।

সুনন্দ ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৪ ০৩:১৮

তৃণমূল ঘনিষ্ঠ এক নেতার অর্থলগ্নি সংস্থাকে আরও প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই সুদীপ্ত সেনের সংস্থা সারদা-কে বিপাকে ফেলা হয়েছিল বলে অভিযোগ এনেছেন তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ কুণাল ঘোষ।

দমদম সেন্ট্রাল জেল থেকে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর অফিসে গোপনে একটি চিঠি পাঠান কুণাল। তাতেই এই অভিযোগ তুলে তিনি লিখেছেন, ‘সারদা গোষ্ঠীর পতন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। পরিকল্পিত একটি চিত্রনাট্যের যবনিকাপাত মাত্র।’ যার প্রেক্ষাপটে ইডি’র তদন্তকারীদের কাছে তাঁর আর্জি, নিরপেক্ষ তদন্তে নাটকের ‘কুশীলবদের’ খুঁজে বার করা হোক।

চিঠিতে কুণাল জানিয়েছেন, তিনি গোটা ঘটনারই নিরপেক্ষ তদন্ত চান। এ-ও চান, সিবিআই তাঁকে এবং সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করুক। শ্যামল সেন কমিশনও ডাকুক। সেখানে তিনি নিজের বক্তব্য জানাতে উৎসুক।

‘তৃণমূল ঘনিষ্ঠ’ নেতাটি ও তাঁর অর্থলগ্নি সংস্থার নাম চিঠিতে বেশ ক’বার উল্লেখ করেছেন কুণাল। ‘তৃণমূলের মূল লক্ষ্য ছিল, সুদীপ্ত সেনকে সরিয়ে সারদার জায়গায় ওই নেতার সংস্থাকে আরও প্রতিষ্ঠিত করা।’ লিখেছেন তিনি। অভিযোগ করেছেন, শুধু সারদা নয়, একাধিক মানি-মার্কেট সংস্থার সঙ্গেও তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে, এবং তার মধ্যে একটি সংস্থার মালিক দলের সদস্যও বটে। অন্য এক লগ্নি সংস্থার মালিকের নাম জানিয়ে লিখেছেন, ‘২০১০-এর অগস্টে কালিম্পঙের ডেলো বাংলোয় তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সুদীপ্তর সঙ্গে বৈঠক করেন। একই সময়ে অন্য এক চিট ফান্ডের মালিকের সঙ্গেও তাঁদের বৈঠক হয়।’

সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে ইডি নিজের মতো তদন্ত করছে। তবে তারা এখনও কুণালকে জেরা করেনি। অন্য দিকে বুধবার রাজ্য পুলিশের হাত থেকে সারদা-তদন্তের ভার নিয়েছে সিবিআই। তারাও এখনও কুণালকে জেরা করেনি। ইডি-সূত্রের খবর: সম্প্রতি কুণালের হাতে আগাগোড়া বাংলায় লেখা ৯১ পাতার যে চিঠিটি তাদের দফতরে এসে পৌঁছেছে, সেটির তারিখ ১ মে। ইডি-র তদন্তকারীরা চিঠির বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছেন।

সারদা-কাণ্ডে জেলবন্দি সাংসদ কুণাল ঘোষ তাঁর চিঠিতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ এনেছেন। পাশাপাশি এ-ও জানিয়েছেন, অভিযোগ প্রমাণ করার মতো তথ্য তাঁর হাতে নেই। তাঁর দাবি: সারদা-সংক্রান্ত যে সব তথ্য-প্রমাণ বিভিন্ন জায়গায় ছিল, গত এক বছরে রাজ্য পুলিশ, বিশেষত বিধাননগর কমিশনারেট সে সব ধাপে ধাপে নষ্ট করে ফেলেছে। তাই সিবিআই বা ইডি তদন্তে বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না বলে তিনি মনে করেন। বিধাননগর কমিশনারেটের যে অফিসার কুণালের তিরের লক্ষ্য, সেই গোয়েন্দা-প্রধান অর্ণব ঘোষ বৃহস্পতিবার এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমি ছুটিতে আছি। এ ব্যাপারে মন্তব্য করব না।”

কুণাল কেন তৃণমূল নেতৃত্বের বিরাগভাজন হয়ে পড়লেন, চিঠিতে তারও বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, রায়গঞ্জ কলেজে তৃণমূল সমর্থকেরা অধ্যক্ষকে মারধর করেছিল। তা সারদার চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয়েছিল, এবং কুণালের দাবি অনুযায়ী, সে সময় তিনি ঘটনাটির সমালোচনাও করেছিলেন। আর তাতেই নেতৃত্ব ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বলে তাঁর দাবি। ‘আমাকে ধমক দেওয়া হয়। আমার সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছাকাছি থেকেও তাঁর অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়াই করা যে কতটা কঠিন ও চাপের, বাইরে থেকে তা বোঝা সম্ভব নয়। কারণ, তাঁর অন্ধকার দিকটি বড় তীব্র।’ পর্যবেক্ষণ কুণালের। তৃণমূলের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা তাঁর এই বক্তব্যকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

কুণালের চিঠিতে অভিযোগের তির অবশ্য তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে আসীন একাধিক ব্যক্তির দিকেই। তিনি লিখেছেন, ‘যে সময়ে আমি সারদা-পরিচালিত মিডিয়ার মাথায় আছি, তখন তৃণমূলের প্রথম সারির নেতা-নেত্রীদের সভা হলেই সারদার চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করতে হতো। ওই সব সভায় ওবি ভ্যান পাঠাতে হতো। এর পিছনে বিপুল টাকা খরচ হয়েছে।’ এখন তাঁর প্রশ্ন, ‘যে সব ধারা আমার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে, সেগুলো তা হলে অন্যদের বিরুদ্ধে কেন প্রয়োগ করা হবে না?’ কুণালের অভিযোগ, ‘পূর্ব মেদিনীপুরে সুদীপ্তর আবাসন-প্রকল্পের জন্য তৃণমূলের কয়েক জন নেতা এক সময়ে বিপুল টাকা দাবি করে আসছিলেন। তৃণমূলের উচ্চমহল থেকে হস্তক্ষেপ করা হয়। আবার সেই উচ্চমহলের কথা মতোই দক্ষিণ কলকাতার দশটি পুজো উদ্যোক্তাকে বিপুল অর্থ দিয়েছিলেন সুদীপ্ত।’

চিঠির বিভিন্ন অংশে একাধিক বার এক আইপিএস অফিসারের নামও উল্লেখ করেছেন কুণাল, যিনি কি না তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সঙ্গে সুদীপ্ত সেনের ‘যোগসূত্র’ হিসেবে কাজ করেছেন বলে তাঁর দাবি। রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশকর্তাটিকে ইডি ইতিমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। বিভিন্ন তৃণমূল নেতার পাশাপাশি ওই পুলিশ অফিসারের নাম উল্লেখ করে কুণাল আক্ষেপ করেছেন, ‘সারদার ক্ষেত্রে দেখলাম, তৃণমূলের প্রভাবশালীরা মালিকের বন্ধু। আমি শুধু মিডিয়া দেখতাম। বাকিরা তো নানা ভাবে যুক্ত! আমাকে সামনে রেখে নিজেরা সাধু সাজছেন!’

প্রসঙ্গত, চিঠির সঙ্গে একটি ‘সুইসাইড নোট’ও জুড়ে দিয়েছেন কুণাল। এবং ইডি’কে আর্জি জানিয়েছেন, তাঁর মৃত্যুর পরে এই চিঠিকেই যেন ‘এফআইআর’ হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রথম পাতাতেই তিনি লিখেছেন, ‘চরম সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া ওরা (পুলিশ ও ষড়যন্ত্রকারীরা) আমার জন্য কোনও পথ খোলা রাখছে না।’ প্রশাসনের উদ্দেশে চিঠির হুঁশিয়ারি ‘যদি জামিনে বেরোতে না দেয়, তা হলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হব।’

সারদা-কর্ণধার সম্পর্কে চিঠিতে কী রয়েছে?

কুণাল জানিয়েছেন, গত ক’মাসে জেল ও আদালতে সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে। সেই সব কথোপকথনের বেশ কিছু অংশ প্রশ্নোত্তরের আকারে চিঠিতে উল্লেখ করেছেন তিনি। যেমন এক জায়গায় সুদীপ্তর বয়ানে লিখেছেন, ‘তৃণমূলের জন্য সব করলাম। আজ সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা ওরাই করল! আমি (সুদীপ্ত) তো পুলিশকে বলেছি যে, তুমি (কুণাল) নির্দোষ। কিন্তু পুলিশ না-মানলে কী করব?’ সুদীপ্তর বয়ানেই আর এক জায়গায় কুণাল লিখেছেন, ‘তুমি (কুণাল) তৃণমূলের সঙ্গে আর ঝগড়া কোরো না। ওরা যা করেছে, তা তো করেইছে। এখন আরও রেগে যাচ্ছে। সরকার বা তৃণমূল অসন্তুষ্ট হয়, এমন কিছু আর তুমি বোলো না।’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি কেনার প্রসঙ্গও এসেছে। কুণালের দাবি: সুদীপ্ত তাঁকে বলেছিলেন, ‘যতটা বলা হচ্ছে, অত বেশি টাকা নয়। দিতে বলেছিল, দিয়েছি। নগদে। তবে ছবিটা পেয়েছিলাম কি না, মনে নেই।’

কুণাল এ-ও জানিয়েছেন, জেলে সুদীপ্তর সঙ্গে কথা বলে তাঁর মনে হয়েছে, সারদা-কর্ণধার এখনও মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন। ‘উনি প্রথমে ভেবেছিলেন, ছেলে (শুভজিৎ) ও স্ত্রী (পিয়ালি)-কে ধরা হবে না। এই সরকার সে কথা রাখেনি। কিন্তু তার পরে এখনও সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারছেন না সুদীপ্ত। এখনও পুলিশ তথা তৃণমূলের শেখানো বুলি বলছেন। এখনও সুদীপ্তর আশা, ভবিষ্যতে এই নেতা-নেত্রীদের কেউ কেউ ওঁকে ওঁর প্রাপ্য ফিরিয়ে দেবেন।’ লিখছেন কুণাল।

চিঠির একটি অংশে কুণাল দাবি করেছেন, সারদা-কাণ্ডে তদন্তরত রাজ্য পুলিশের অফিসারদের তিনি বারবার বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে চাইলেও পুলিশ তাঁর কথায় কর্ণপাত তো করেইনি, উল্টে বারবার তাঁকে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করেছে। কোনও জেরা না-করে তাঁকে শুধু এক জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। ‘পুলিশ যা গল্প সাজাচ্ছে, তা থেকে বেরোব কী করে? প্রশ্ন কুণালের। বন্দি সাংসদের দাবি: তাঁকে বলা হয়েছিল, ১৬৪ ধারা (আদালতে গোপন জবানবন্দি) প্রত্যাহার করে নিলে নতুন করে মামলায় জড়ানো হবে না, ঘনিষ্ঠদের হয়রান করা হবে না। অথচ ১৬৪ প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরেও তাঁকে একের পর এক মামলায় ফাঁসানো শুরু হয়েছে বলে চিঠিতে আক্ষেপ করেছেন কুণাল। ইডি’কে তিনি লিখেছেন, ‘প্রথমে বিধাননগর কমিশনারেট, তার পরে একের পর এক থানা তদন্তের নামে প্রহসন চলছে! কোথাও জেরা করা হচ্ছে না। কোথাও আমার বক্তব্য নথিভুক্ত করা হচ্ছে না!’

‘এরা সবাই মিথ্যেবাদী, সুবিধাবাদী, অকৃতজ্ঞ, বিশ্বাসঘাতক।’ বলছেন বন্দি সাংসদ।

sunanda ghosh kunal ghosh kunal's confidential letter
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy