সাইকেলে গেরুয়া পতাকা লাগিয়ে মিছিলে হাজির হওয়া তিন যুবককে দেখে ঝোলা ব্যাগ কাঁধে এক মাঝবয়সি বললেন, ‘‘আজ তো এসেছিস। ভোটটা কোথায় দিবি? এ দিক-ও দিক করিস না ভাই।’’ মুখে লজ্জার হাসি টেনে ওই যুবকদেরই এক জন বললেন, ‘‘তোমার কাছে প্রমাণ আছে? দেখাতে পারবে? মিছিলে যখন এসেছি, তখন ভোটও ঠিক জায়গাতেই পড়বে।’’
এর মধ্যেই সংশয়, মুখ চাওয়াচাওয়ি। আগে থেকে ঠিক করা কর্মসূচি, তবু শ্রীরামপুরের নওগাঁ মোড়ে লোক এত কম কেন! মাঝারি নেতারা অবশ্য বড় নেতাদের আশ্বস্ত করে চলেছেন, ‘‘আরে সব্বাইকে বলা হয়েছে। তুমি দেখ না, চলে আসবে।’’
এই আলোচনার মধ্যেই বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ নওগাঁর মোড়ে এসে দাঁড়াল শ্রীরামপুরে এ বারের বিজেপি প্রার্থী দেবজিৎ সরকারের সাদা এসইউভি। নেমেই জনা তিরিশ কর্মী-সমর্থকের মধ্যে থেকে একটি সাইকেল চেয়ে নিয়ে তাতে সওয়ার হলেন বিজেপির যুব নেতা। হ্যান্ডল ডান দিকে-বাঁ দিকে ঘুরিয়ে টাল খেতে খেতে কোনওমতে এগিয়ে গিয়ে চেঁচাতে শুরু করলেন, ‘‘কোন দিকে যাব? আরে রাস্তাটা তো বল?’’ কিন্তু, উত্তর দেবে কে? নেতারা ব্যস্ত মিছিল সংগঠনে। নওগাঁর মোড় থেকে ভাঙাচোরা যে রাস্তাটা দিল্লি রোডে উঠেছে, সাইকেল নিয়ে একাই সে পথ ধরলেন দেবজিৎ। কিছুটা এগিয়ে ব্যালেন্স ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘‘ধুর! সাইকেলে হবে না। বাইক দে, বাইক।’’ বাইকে বসে জোরে অ্যাকসিলেটর ঘুরিয়ে চেঁচাতে শুরু করলেন, ‘‘স্লোগান দে, স্লোগান!’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
স্লোগান-টনিক খাওয়া এই উৎসাহ অবশ্য মিনিট কয়েকের মধ্যেই উধাও। এক দলীয় কর্মী কিছু ক্ষণ আগেই ‘খবর’ এনেছিলেন, পিছনে তৃণমূলের মিছিল আসছে। এ বার তিনিই প্রবল বিরক্ত ভাবে বললেন, ‘‘অনেকক্ষণ থেকে বলছি, ওদের মিছিল আসছে। রাস্তায় থাকলে হবে না, গলিতে ঢোকো।’’ ঠিক পিছনেই তৃণমূলের মিছিল দেখে বাইক বন্ধ করে চায়ের দোকানে ঢুকে চুপচাপ বসে পড়লেন কয়েক জন। সঙ্গে থাকা তিনটি বাইকে পাঁচ জনকে নিয়ে ঝড়ের গতিতে পথের বাঁকে হারিয়ে গেলেন দেবজিৎ-ও। তৃণমূলের মিছিলটা নওগাঁ মোড় পার করল ঝাড়া সাত মিনিট ধরে। তাতে অবশ্য শ্রীরামপুরের বিদায়ী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় নেই। রাতের দিকে ফোনে পাওয়া গেলে দেবজিৎ বলেন, ‘‘আমাদের লোক বেশি ছিল না। ঝামেলা হতে পারত।’’
অনেকে বলছেন, শ্রীরামপুর কেন্দ্রটিকে এ বারই প্রথম রাজনৈতিক লড়াইয়ের জায়গা হিসেবে নিয়েছে বিজেপি। কারণ, ২০১৪ সালে শ্রীরামপুরে বিজেপি প্রার্থী করেছিল গায়ক বাপ্পি লাহিড়ীকে। রাজনীতির লোক না হওয়ায় তিনি হারলে সরাসরি সেই হারের দায় দলের উপর পড়ে না। বরং জিতলে বাপ্পির জয়কে বিজেপির জয় হিসেবে দেখানো যেতে পারে। সেই সময় বাপ্পির রোড-শোয়ে মানুষের ঢল দেখে কিছুটা আশাবাদীও হয় বিজেপি। শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত শ্রীরামপুর এবং চাঁপদানি, এই দু’টি বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটের নিরিখে বাপ্পি এগিয়ে থাকলেও দেড় লাখেরও বেশি ভোটে জিতে শেষ হাসি হাসেন কল্যাণই। এ বার সেখানে শ্রীরামপুরে বিজেপি প্রার্থী করেছে যুব মোর্চার সভাপতি দেবজিৎকে। অর্থাৎ, একেবারে সংগঠনের ছেলে। সাংগঠনিক লড়াই। কিন্তু, যে সংগঠনের জোরে লড়তে চাইছে বিজেপি, সেই সংগঠন আদৌ মজবুত তো?
রাতে ফোনে উত্তেজিত যুবনেতার উত্তর, ‘‘সাংগঠনিক ভাবে পিছিয়ে থাকার মাপকাঠি যদি দেওয়াল লেখা বা ফ্লেক্স টাঙানো হয়, লোককে চমকে ধমকে দেওয়াল চুরি করে নেওয়া হয়, তা হলে ও রকম সংগঠন না-থাকাই ভাল।’’ সেই সঙ্গে বললেন, ‘‘এত দিন বিজেপি শুধু ভোটে দাঁড়াত। এ বার বিজেপি ভোটে লড়বে।’’
তৃণমূল শিবিরের অবশ্য বক্তব্য, গত বারের থেকেও বেশি ব্যবধানে জিতবেন ‘দুঁদে আইনজীবী’ কল্যাণ। সে যতই তাঁর কাছে পৌঁছতে না-পারা, সময়ে সময়ে সাংসদের মেজাজ হারানো, এলাকায় একের পর এক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, ফুরফুরা শরিফের রেলপথ বাস্তবায়ন না-হওয়ার মতো অভিযোগ থাকুক না কেন। চিন্তা রয়েছে, শ্রীরামপুরের হিন্দিভাষী এলাকার ভোট নিয়েও। কল্যাণের এ বারের ভোটের প্রধান দুই সেনাপতি দিলীপ যাদব এবং সুবীর মুখোপাধ্যায় অবশ্য সে সব উড়িয়ে দিয়ে দাবি করলেন, ‘‘বিজেপি’র সংগঠন কোথায়, সবই তো খুচরো ভোট। তবে যেখানে যেটুকু অসুবিধা ছিল দাদার ক্যারিশমায় সব ম্যানেজ হয়ে গিয়েছে।’’ কংগ্রেসের প্রার্থী দেবব্রত বিশ্বাস অবশ্য বলছেন, ‘‘তৃণমূল নয়, এটা মোদী আর রাহুলের লড়াই।’’
এমনিতেই গুছিয়ে প্রচার করার জন্য ভাল নামডাক রয়েছে দু’বারের সাংসদ কল্যাণের। ভোট ঘোষণা হতেই ডায়েরি মেনে রোদে পুড়ে, জলে ভিজে শ্রীরামপুর জুড়ে নিজের কায়দায় প্রচার শুরু করে দিয়েছেন তিনি। চাঁপদানিতে বৃষ্টি ভেজা সভায় বক্তৃতা করে উঠেই ভাঙা গলায় বললেন, ‘‘ওদের কে দাঁড়াল বড় কথা নয়। তৃণমূলই যে একমাত্র তাঁদের কথা বলে, তা এখানকার মানুষ জানেন।’’ নিজের মেজাজ হারানো নিয়ে কল্যাণের সাফ উত্তর, ‘‘শাসন করা তাঁরই সাজে, সোহাগ করে যে!’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমি দিল্লিতে যাই এখানকার মানুষের কথা বলব বলে। আর এখানে থাকি এখানকার মানুষের সমস্যা শুনব বলে।’’
গত বারে দ্বিতীয় হওয়ার পর এ বারও টিকিট পাওয়া বাম প্রার্থী তীর্থঙ্কর রায়ের অবশ্য তির্যক মন্তব্য, ‘‘কল্যাণবাবুকে জলসায় সহজে পাওয়া যায়। কিন্তু, সমস্যার কথা বলতে গেলে ওঁর বৃত্ত ভেদ করে কাছে যাওয়া যায় না।’’ শ্রীরামপুরের এই ভূমিপুত্র তাই ভাল ফল করতে এ বারও চষে ফেলছেন গ্রাম-শহর। কিন্তু হিসেব কতটা মিলবে?
কল্যাণের চ্যালেঞ্জ গত বারের ব্যবধান বাড়ানো। আপাতত পেনসিল দিয়ে নোটবুকে চলছে অঙ্ক কষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy