Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
State News

চকচকে রাস্তা-আলো, উন্নয়ন ঢাকতে পারেনি বাগান-বনবস্তির কাজের হাহাকার

গ্রামের এক প্রান্তে থাকা ছাপোষা অজয় ইচ্ছে করেই অন্য প্রান্তের ফরেস্ট বাংলোর পথ মাড়াননি। তবে স্বপ্নেও ভাবেননি মুখ্যমন্ত্রী নিজেই চলে আসবেন তাঁর দোরগোড়ায়।

দলগাঁও চা বাগানে কাজে ব্যস্ত শ্রমিকরা। তার ফাঁকেই শোনালেন তাঁদের কাহিনি।

দলগাঁও চা বাগানে কাজে ব্যস্ত শ্রমিকরা। তার ফাঁকেই শোনালেন তাঁদের কাহিনি।

সিজার মণ্ডল
আলিপুরদুয়ার শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৯ ১৪:০৮
Share: Save:

চার বছর আগের সেপ্টেম্বর মাসের সকালের স্মৃতিটা অজয় শর্মার এখনও টাটকা। আর হবে নাই বা কেন! সে দিন তাঁর ছোট্ট কাঠের বাড়ির সামনে এসে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। দেখেন, বারান্দার সামনে কাঠের ভাঙা সিঁড়িতে বসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!

আগেই শুনেছিলেন বস্তিতে মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন। কিন্তু, গ্রামের এক প্রান্তে থাকা ছাপোষা অজয় ইচ্ছে করেই অন্য প্রান্তের ফরেস্ট বাংলোর পথ মাড়াননি। তবে স্বপ্নেও ভাবেননি মুখ্যমন্ত্রী নিজেই চলে আসবেন তাঁর দোরগোড়ায়।

সে দিন একই হাল হয়েছিল অজয়ের পড়শি শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁর কথায়, ‘‘হঠাৎ দেখি অজয়ের বাড়ির সামনে এসে বসে পড়লেন দিদি। সঙ্গে কেউ নেই। এক জন সিকিউরিটি গার্ডও নয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ঘিরে ধরলেন এলাকার মানুষ। সবার কথা খুব মন দিয়ে শুনছিলেন। আমরা বললাম আমাদের অভাব-অভিযোগের কথা। বলেছিলাম, কী ভাবে জয়ন্তী নদী গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের গ্রাম।”

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

২০১৫ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘুরে যাওয়ার পর পাকা হয়েছে গ্রামের রাস্তা।

বক্সা টাইগার রিজার্ভের কোর এলাকার জয়ন্তী বন বসতির দু’হাজারের বেশি বাসিন্দা এক বাক্যে স্বীকার করেন, ‘দিদি কথা রেখেছিলেন’। দিদি ফিরে যাওয়ার পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শ্যামল-অজয়দের বাড়ির সামনের রাস্তা পাকা হয়ে গিয়েছিল। মোবাইল টাওয়ার বসেছিল। বাসিন্দাদের দাবি মতো জয়ন্তীর হাটতলা ১০ লাখ টাকা খরচ করে ঝা চকচকে করে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু, তার পরেও গোটা গ্রামেই অনুভব করা যায় একটা অন্য সুর। শ্যামল বলছিলেন, ‘‘পাকা রাস্তা, সোলারের আলো সব ভাল। কিন্তু সে সবের জন্য তো আমাদের প্রাণে বাঁচতে হবে। রাস্তায় বেরোলে হাতি মারে। ফি বছর বর্ষায় রাত জেগে থাকি, কখন নদী গিলে খাবে। গত বছর থেকে নদীর বোল্ডার তোলার কাজও বন্ধ। কাজ নেই। খাবে কী মানুষ! গ্রাম ছেড়ে কাজের খোঁজে চলে যাচ্ছে সবাই। আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ: ফরেস্ট বস্তি উচ্ছেদ করতে হবে।”

বক্সা টাইগার রিজার্ভের মধ্যেই গারো বস্তি। সেখানকার বাসিন্দা লালসিংহ ভুজেল কয়েক দশক ধরে বন বসতির বাসিন্দাদের অধিকার নিয়ে লড়ছেন। তিনি বললেন ‘‘সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের দেওয়া হিসাব অনুসারে আলিপুরদুয়ার জেলাতেই রয়েছে ৫৫টি বনবস্তি, যার বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। এর মধ্যে ৪২টি বক্সাতেই।’’ লালসিংহের কাছেই জানা গেল, সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, সব বনবস্তি ফাঁকা করে দিতে হবে। তিনি বললেন, ‘‘রাজ্য সরকারের কাছ থেকে পুনর্বাসনের কোনও প্রস্তাব আমরা পাইনি।” প্রশ্ন করলাম, আপনারা কি মনে করছেন বিজেপি আপনাদের পাশে দাঁড়াবে? কারণ তার আগেই জয়ন্তী থেকে শুনে এসেছি, মঙ্গলবার জয়ন্তীতে গিয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী জন বার্লা। তিনি আশ্বস্ত করেছেন সেখানকার বাসিন্দাদের। লালসিংহ প্রশ্নটা শুনেই হেসে উঠলেন... ‘‘বাম-ডান কেউ আমাদের পাশে কখনও দাঁড়ায়নি। সে প্রত্যাশাও নেই। তবে একটা ফারাক আছে। আগে আমরা আমাদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করলে সরকার বাধা দিত না। এখন পুলিশ-প্রশাসন বাধা দেয়।”

ঘোর বর্ষায় প্লাবিত হয় জয়ন্তী নদী। তাতে ভেসে যায় জয়ন্তী গ্রাম।

বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে লালসিংহ বললেন, ‘‘আগের জমানার নেতাদের উপর তিতিবিরক্ত হয়ে মানুষ পরিবর্তন এনেছিল। কিন্তু পরিবর্তনের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল জনগণের বাতিল করা নেতারাও দল বদলে পরিবর্তনে যোগ দিয়েছে। আবার পরিবর্তন করলেও ওরা সুযোগ বুঝে ফের দল বদলাবে।” ইঙ্গিতটা বেশ স্পষ্ট। তৃণমূল প্রার্থী দশরথ তিরকে এক সময়ে ওই এলাকার দাপুটে আরএসপি নেতা ছিলেন।

আরও পড়ুন: দেবের সভার প্রচারে জংলা পোশাকে তৃণমূলের জয় হিন্দ বাহিনী, কমিশনে বিজেপি

বক্সার জঙ্গল ছেড়ে এগোতেই পর পর চা-বাগান। জাতীয় সড়কের দু’ধারে সবুজ কার্পেটের মতো বিছানো একের পর এক। পরিসংখ্যান বলে, জেলা ভাগের পর আলিপুরদুয়ারেই রয়েছে ৬৩টি বাগান। বাইরে থেকে যা মখমলের মতো মসৃণ, বাগিচা পেরিয়ে বাগান শ্রমিকদের বস্তিতে গেলেই ততটাই কর্কশ। ন্যূনতম মজুরি ২৫০ টাকা করার দীর্ঘ দিনের দাবি রয়ে গিয়েছে ঠান্ডাঘরেই। মাত্র ১৭৬ টাকা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় চা-শ্রমিকদের। পরিসংখ্যান বলে, ৬৩টির মধ্যে বন্ধ পাঁচটি। রুগ্ন ২০টি বাগান। ২০১৩ সাল থেকে বন্ধ বান্দাপানি চা-বাগান। সেখানে শ্রমিকদের পানীয় জলের জন্যও নির্ভর করতে হয় পড়শি দেশ ভুটানের উপর। বান্দাপানি, লঙ্কাপাড়া, ক্যারনের মতো চা-বাগানে পথ চলতে চলতে মনে পড়ছিল জয়ন্তীর শ্যামলের কথা, ‘‘কাজ নেই। কোথাও কাজ নেই... খাব কী?”

জয়ন্তী যাওয়ার পথে ডিমা নদীর উপর পাকা সেতু হয়েছে এই সরকারের জমানাতেই। সেতু না থাকার ফলে আগে বর্ষায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত জয়ন্তী।

বন্ধ বাগানের অনেকেই বেঁচে আছেন রাজ্য শ্রম দফতরের ফাওলাই প্রকল্পের মাসিক দেড় হাজার টাকা ভাতার উপর ভর করে। প্রেমলাল মু্ন্ডা আগে বান্দাপানি বাগানে কাজ করতেন। এখন ভুটানের ডলোমাইট খাদানে কাজ করেন। তিনি বললেন, ‘‘আগে আট ঘণ্টা কাজ করে ১৪ কিলো চা তুলতে হত। এখন ২০ কিলো তুলতে হয়। তার বদলে মেলে ১৭৬ টাকা। ভুটানের খাদানে পাওয়া যায় ৩০০ টাকা।” কাজ নেই— হাহাকারের মধ্যেই কাজের খোঁজে, একটু বেশি টাকার আশায় বাগান শ্রমিকদের নতুন প্রজন্ম পাড়ি দিচ্ছে ভুটান, শিলিগুড়ি বা দক্ষিণ ভারতে। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চলছে মানুষ পাচারের রমরমা কারবার।

আরও পড়ুন: বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিন, আহ্বান শঙ্খ-নাসিরুদ্দিনদের

এ সবের মাঝেই লক্ষ্মীপাড়া চা-বাগানে জন বার্লা বোঝাচ্ছিলেন ভোটের গাণিতিক প্যাঁচ পয়জার। এক সময়ে ডুয়ার্সের আদিবাসী জনজাতি সংগঠন আদিবাসী বিকাশ পরিষদের দাপুটে নেতা জন এ বার বিজেপি প্রার্থী। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর জনের দাবি, নাগরাকাটা, মাদারিহাট, কালচিনি, কুমারগ্রাম বিধানসভায় যেখানে চা-শ্রমিক এবং জনজাতির মানুষ সিংহ ভাগ, সেখানে তিনিই ভোট পাবেন। সেই সঙ্গে তাঁর ঝুলিতে আসবে ওই এলাকার গোর্খা ভোটও। কারণ এখানেও বিমল গুরুংয়ের ছায়া লম্বা। এক দিকে তিনি বিমলের বন্ধু, অন্য দিকে বিমল এখন বিজেপির সঙ্গে। সব মিলিয়ে ওই চার বিধানসভায় ভাল ভাবে এগিয়ে যেতে পারলেই তাঁর আর চিন্তা নেই। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোট এবং বিধানসভা ভোটের পরিসংখ্যানও সমর্থন করে জনের তত্ত্বকেই। লোকসভায় বিজেপি প্রার্থীর পাওয়া ৩ লাখ ৩৫ হাজার ভোটের মধ্যে ২ লাখ ২৮ হাজারই এসেছে ওই চার বিধানসভা থেকে। বিধানসভা নির্বাচনেও ওই চারটি কেন্দ্রে ভাল ফল করেছে বিজেপি। তৃণমূলের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে মাদারিহাট কেন্দ্র। জনের ভোট ব্যাঙ্ক যে আড়েবহরে বেড়েছে তা টের পাওয়া যায় চা-বাগানে ঘুরলেই। দলগাঁও চা-বাগানের মহিলা কর্মীরাই যেমন সটান বললেন, ‘‘জন আমাদের নিজেদের লোক। বাগানের লোক। ওকেই ভোট দেব।”

তথ্য এবং পরিসংখ্যান তৃণমূলের কাছেও রয়েছে। জেলা তৃণমূল সভাপতি মোহন শর্মা নিজেও জানেন, আলিপুরদুয়ারের জঙ্গল-বাগানের আনাচে-কানাচে কী হচ্ছে। তবে তাঁর হাতের তাস তুফানগঞ্জ, ফালাকাটা এবং আলিপুরদুয়ার কেন্দ্র, যেখানে জনজাতি ভোট কম। তাঁর সমীকরণ পরিষ্কার। ওই তিন বিধানসভা থেকে এগিয়ে রাখতে হবে দলের প্রার্থীকে। কিন্তু তা কি সত্যি হবে? ভাল ভাবে বুঝতে ফোন করলাম দীর্ঘ দিনের পরিচিত কালচিনির এক আরএসপি নেতাকে। ওই এলাকার দাপুটে নেতা ছিলেন রামকুমার লামা। ফোন ধরতেই বললাম, ‘‘আপনি কী প্রচারে ব্যস্ত?’’ উত্তর এল, ‘‘আমি ভুবনেশ্বরে।’’ ভোটের মরশুমে ভুবনেশ্বর? এ বার ফোনের উল্টো দিকের জবাব, ‘‘ভোট নিয়ে ভাবলে কি পেট চলবে?’’

ফি বছর বর্ষায় কী ভাবে বাঁধ ভেঙে গ্রামে ঢুকে যাচ্ছে জয়ন্তী নদী, দেখাচ্ছেন জয়ন্তীর বাসিন্দা শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়।

আলিপুরদুয়ার শহর লাগোয়া দমনপুরের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘দিদি আমাদের আলাদা জেলা দিয়েছেন। জলের মতো টাকা খরচ করেছেন জেলার উন্নতির জন্য। দিদির উপর আমাদের কোনও ক্ষোভ নেই। কিন্তু সমস্যা দিদির ভাই-বোনেরা।” ওই ব্যবসায়ীই বলেন, ‘‘ক’দিন আগেই কামাখ্যাগুড়ির খোয়াড়ডাঙায় বিজেপির পতাকা লাগানোর জন্য এক যুবকের বাড়িতে হামলা করে তৃণমূল কর্মীরা। ঝামেলার মাঝে পড়ে গিয়ে মারা যান ওই যুবকের অসুস্থ বৃদ্ধা মা।’’ তিনি বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটের সময়কার স্মৃতি এখনও মানুষের মনে টাটকা।’’

আরও পড়ুন: বাংলাই এ বার দিল্লি গড়বে, মাথাভাঙার জনসভা থেকে ডাক মমতার

ওই ব্যবসায়ীর কথা শুনে গিয়েছিলাম খোয়ারডাঙায় হরিদাস দাসের বাড়ি। সুনসান বাড়ি। কেই কোথাও নেই। বাড়িতে গিয়ে ডাকাডাকি করে রাস্তায় পৌঁছতেই দেখি, বাইকে সওয়ার বেশ কিছু যুবক। তাঁদের এক জন নিজেকে সুকুমার দাস বলে পরিচয় দিয়ে বললেন তিনি ওই এলাকার তৃণমূল বুথ সভাপতি। তাঁর দাবি, হরিদাস সবটাই মিথ্যে বলেছেন। আদৌ কোনও গন্ডগোল হয়নি। অসুস্থতার কারণেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়েছে। সুকুমারের এক সঙ্গী মিলন মণ্ডল বলেন, ‘‘আপনি পাড়া প্রতিবেশী বা হরিদাসের আত্মীয়দের জিজ্ঞাসা করে দেখুন।’’ প্রায় টানতে টানতেই তাঁরা নিয়ে গেলেন হরিদাসের শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে প্রত্যেকের মুখেই এক কথা, ‘‘আমরা কিছু দেখিনি। আমরা জানি না।’’ হরিদাস কোথায় সেই খোঁজও নাকি নেই তাঁদের কাছে। নেই জামাইয়ের ফোন নম্বরও।

খোয়ারডাঙা থেকে ফেরার পথে মাথার মধ্যে ঘুরছিল পরিচিত বাংলা ছবির সেই বিখ্যাত সেই সংলাপ: ‘মাস্টারমশাই আপনি কিছু দেখেননি’।

ছবি: সিজার মণ্ডল।

(পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেবাংলায় খবরজানতে পড়ুন আমাদেররাজ্যবিভাগ।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE