Advertisement
E-Paper

আধবেলাতেই মত পাল্টে বাড়ির পথে

সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের তাবড় চিকিৎসকেরা গত ১০ মাস ধরে বহু চেষ্টা করেও কিছুতেই সুস্থ করতে পারেননি তাঁকে। নানাবিধ চিকিৎসার পরেও সুস্থ করা যায়নি বলেই তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে জেলে ফিরিয়ে নেওয়া যায়নি।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৫২
ছাড়া পাওয়ার পর মদন মিত্র। সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

ছাড়া পাওয়ার পর মদন মিত্র। সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের তাবড় চিকিৎসকেরা গত ১০ মাস ধরে বহু চেষ্টা করেও কিছুতেই সুস্থ করতে পারেননি তাঁকে। নানাবিধ চিকিৎসার পরেও সুস্থ করা যায়নি বলেই তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে জেলে ফিরিয়ে নেওয়া যায়নি। অথচ এই ভেল্কিটাই দেখাল আলিপুর জেলা ও দায়রা আদালতের অবকাশকালীন আদালতের নির্দেশ। শনিবার বিকেলে জামিনের খবর শোনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একেবারে ‘ফিট’ হয়ে রবিবার দুপুরে বাড়ি ফিরে গেলেন সারদা-কাণ্ডে ধৃত রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র! আর মন্ত্রীর এই সুস্থতায় সিলমোহর দিল এসএসকেএমের মেডিক্যাল বোর্ড! যা দেখে বিরোধীদের কটাক্ষ, ‘জামিন ওষুধেই রাতারাতি সুস্থ মদন’! অনেকে আবার এসএসকেএমের চিকিৎসকদের ‘দক্ষতা’কে কটাক্ষ করেছেন।

সারদা-কাণ্ডে গত বছর ১২ ডিসেম্বর সিবিআই গ্রেফতার করেছিল মদন মিত্রকে। সিবিআই হেফাজতে কয়েক দিন থাকার পরে আদালত তাঁকে আলিপুর জেলে রাখার নির্দেশ দেয়। কিন্তু জেলে ঢোকার ১৫ দিনের মাথায় অসুস্থ হয়ে পড়ায় মন্ত্রীকে ভর্তি করা হয় এসএসকেএমে। কিছু দিন পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে সুস্থ ঘোষণা করে ছুটি দিয়ে দিলেও জেলে ফেরা নিয়ে টালবাহানা শুরু করেন মন্ত্রী। কিন্তু তখন চিকিৎসকেরা তাঁকে ‘সুস্থ’ ঘোষণা করায় জেলে ফেরা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না মন্ত্রীর। জেলে ফিরলেও ‘হেভিওয়েট’ বন্দির ইচ্ছে মতো সেজে ওঠে আলিপুর জেলের মন্দির ওয়ার্ড। মন্ত্রীর মেজাজ খুশ রাখার জন্য তৈরি করা হয় ফুলের বাগানও। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ফের মদনবাবুকে ভর্তি করা হয় এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডের ২০ নম্বর কেবিনে। সেই থেকে হাসপাতালেই ছিলেন মন্ত্রী। জেলে আর ফেরেননি। তখন থেকে বিরোধীরা বলতে শুরু করেন, কারাবাস থেকে মুক্তি পেতেই মন্ত্রী ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে।

মদনের অসুস্থতা নিয়ে শুধু বিরোধীরা নয়, গত অগস্টে আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল সিবিআই-ও। সে সময় এসএসকেএমের পক্ষ থেকে মেডিক্যাল বোর্ড জানিয়েছিল, নানা রকম অসুস্থতায় ভুগছেন মন্ত্রী। রোগের লম্বা এক ফিরিস্তিও দিয়েছিলেন তাঁরা। সেই তালিকায় ছিল হাইপারটেনশন, টাইপ-টু ডায়াবেটিস, ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি, সিওপিডি, স্লিপ অ্যাপনিয়া এবং মানসিক অবসাদের মতো জটিল কিছু রোগ। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, সব সময়ের জন্যই মন্ত্রীকে থাকতে হবে তাঁদের তত্ত্বাবধানে। তাই মন্ত্রীকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া সম্ভব নয় বলে তখন দাবি করেছিলেন চিকিৎসকেরা।

চিকিৎসকদের এই বক্তব্যের উপরে ভিত্তি করেই শনিবার জামিন পাওয়ার পরে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে চাননি মদনবাবু নিজেও। শনিবার সন্ধ্যায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘একেবারে সুস্থ হয়ে বুধবার নাগাদ বাড়ি ফিরব।’’ তাঁর ঘনিষ্ঠদেরও বক্তব্য ছিল, জামিন পাওয়ার পর রাতারাতি বাড়ি ফিরে গেলে এ নিয়ে নানা কথা উঠবে।

কিন্তু দ্রুত পাল্টে গেল পরিস্থিতি। রাত ১১টা নাগাদ জেল কর্তৃপক্ষ ‘রিলিজ অর্ডার’ পৌঁছে দেন হাসপাতালে। চিকিৎসকদের একাংশের বক্তব্য, রাতেই হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে বার্তা যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। তার পরেই তড়িঘড়ি মেডিক্যাল বোর্ডের বৈঠক ডেকে মদনকে সুস্থ ঘোষণা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। যার জেরে নতুন করে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, কী এমন অসুস্থ ছিলেন যে তাঁকে এত দিন হাসপাতালে থাকতে হল? আর হঠাৎ জামিন পাওয়ার পরেই বা কী করে রাতারাতি সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি? এ বিষয়ে অবশ্য মুখ খুলতে চাননি রবিবারের বৈঠকে থাকা মেডিক্যাল বোর্ডের কোনও সদস্য। চার জনের মধ্যে তিন জন ফোন না ধরলেও চিকিৎসক নির্মলেন্দু সরকার বলেন, ‘‘রোগীর বিষয়ে বাইরে কথা বলার নিয়ম নেই। মাফ করবেন।’’

চিকিৎসকেরা সরাসরি মুখ না খুললেও আড়ালে তাঁদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন অনেকেই। যে ভাবে উডবার্ন ওয়ার্ডের একটি কেবিন মাসের পর মাস কার্যত দখল করে রেখেছিলেন মন্ত্রী, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। প্রশ্ন উঠছে বার বার চিকিৎসকদের একাংশ এ নিয়ে সরব হলেও মন্ত্রীর জন্য গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড তাতে গুরুত্ব দেয়নি কেন?

বিরোধীরা অনেকেই অবশ্য মেডিক্যাল বোর্ডের চিকিৎসকদের দোষ দেখছেন না। তাঁদের কথায়, ‘‘সরকারি হাসপাতালের সব কিছুই হয় নবান্নের নির্দেশে। সেই নির্দেশেই এত দিন মন্ত্রীকে অসুস্থ বলে দাবি করতে হয়েছে। আবার উল্টো নির্দেশ আসতেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গুরুতর অসুস্থ মন্ত্রীকে ‘সুস্থ’ ঘোষণা করে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দিতে হয়েছে!’’

যদিও হাসপাতালের অন্য একটি সূত্রের মতে, মেডিক্যাল বোর্ড বলেছে মন্ত্রীর স্লিপ অ্যাপনিয়া, হাইপারটেনশন, সিওপিডি, ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি, অবসাদ, স্নায়ু ও পেশীগত সমস্যা রয়েই গিয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বাড়িতে থাকলেও স্লিপ অ্যাপনিয়ার জন্য সব সময় অক্সিজেন মজুত রাখতে হবে। এ দিনও বিকেলের পর থেকে মন্ত্রীকে অক্সিজেন নিতে হয়েছে। ২৪ ঘণ্টাই দেখাশোনার জন্য তাঁর কাছে এক জনকে সব সময় থাকতে হবে। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি, রক্তচাপ পরীক্ষা এবং মনোবিদের দেখাশোনা চলবে। এ ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে মন্ত্রীর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে দেখে আসবে এসএসকেএমের মে়ডিক্যাল বোর্ড। এসএসকেএমের এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘ওঁর মূল রোগ মানসিক সমস্যা এবং স্লিপ অ্যাপনিয়া। বাড়িতে স্লিপ অ্যাপনিয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা নজরদারি সম্ভব। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে, ঘরের লোকেদের সঙ্গে থাকলে ওঁর মানসিক অবসাদ অনেকটাই কেটে যাবে। সে জন্যই জামিন পেয়ে যাওয়ায় ওঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’’

চিকিৎসক বা মদন-ঘনিষ্ঠরা যা-ই বলুন, বিরোধীরা কিন্তু কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না। তাদের দাবি, মোদী ও দিদির বোঝাপড়াতেই এমন ঘটনা ঘটল! সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘মদন জেলে ছিলেন না। ছিলেন হাসপাতালে। যেই জামিন পেলেন, অমনি ডাক্তার বললেন ফিট! জামিনের পর দিনই উনি বাড়ি চলে গেলেন! এর পরে কি আর কিছু বুঝতে বাকি থাকে?’’ সিপিএমের আর এক রাজ্য নেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘নবান্নের নির্দেশই সব! হাসপাতাল, চিকিৎসক, অসুস্থতা— এ সব কিছুই না!’’ আইনজীবী তথা প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্যের প্রশ্ন, ‘‘জামিনের সঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ড বসার কী সম্পর্ক? চিকিৎসকেরা তো কাজ করবেন রোগীর শারীরিক অবস্থা বুঝে! তাঁরা যদি কারও নির্দেশে মন্ত্রীকে ফিট বলে ঘোষণা করে ছেড়ে দিয়ে থাকেন, তা হলে তো চিকিৎসকদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে!’’

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর দাবি, ‘‘মদন মিত্র গুরুতর অসুস্থ ছিলেন না। জেলকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য উনি অসুস্থতাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতেন। এখন সেই প্রয়োজন ফুরিয়েছে। মোদী-দিদির সখ্যের জেরে জামিন হয়েছে ওঁর!’’ আর বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, ‘‘মাত্র আধ বেলার মধ্যে মাননীয় মন্ত্রীকে সুস্থ করে তোলায় এসএসকেএমের চিকিৎসকদের অভিনন্দন জানাচ্ছি!’’

হাসপাতাল থেকে মদনের তড়িঘড়ি মুক্তি ঘিরে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কেউ আনুষ্ঠানিক ভাবে মু্খ খুলতে চাননি। তবে দলের এক প্রথম সারির নেতার মন্তব্য, ‘‘মদনের শরীর কিন্তু সত্যিই খারাপ। ভাল করে কথাও বলতে পারছে না। কিন্তু হাসপাতাল থেকে এত দ্রুত বাড়ি গেল কেন, বুঝতে পারছি না!’’

মদন-ঘনিষ্ঠ আইনজীবীদের বক্তব্য, মন্ত্রী বেশ কিছু দিন ধরেই অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। জেলে ফিরতে চাইছিলেন। জামিন পাওয়ার পরে তিনি চটজলদি কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চাননি। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকাতেই তাঁকে বের করে আনা হল।

কী সেই পরিকল্পনা?

তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, ‘‘তড়িঘড়ি জেল হেফাজত থেকে মদনকে বের করে আনা না গেলে আমাদের ভয় ছিল, হাইকোর্টে মামলা ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মদনের জামিনের উপরে স্থগিতাদেশ জারি হতে পারে। কিন্তু জামিনে বেরিয়ে যাওয়ার পরে হাইকোর্টে মামলার শুনানির জন্য কিছুটা সময় মিলবে। ওই সময়টাই আমরা কিনতে চেয়েছি।’’

যদিও সিবিআই সূত্রের খবর, তড়িঘড়ি মন্ত্রীর হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়াকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেই হাইকোর্টে তাঁর জামিন বাতিলের আবেদন জানানো হবে। সিবিআইয়ের এক অফিসারের কথায়, ‘‘যে ভাবে শনিবার আমাদের অন্ধকারে রেখে জামিনের শুনানি হল, রাতারাতি জেল থেকে ডিসচার্জ অর্ডার বেরোল এবং রবিবার হাসপাতাল তাঁকে ছেড়ে দিল— তা থেকেই বোঝা যায়, তিনি কতটা প্রভাবশালী। এ জন্য তাঁকে হেফাজতে রাখা প্রয়োজন। সে কথাই উচ্চ আদালতে জানাব।’’ এ দিনই আদালতের নির্দেশে মদনের আইনজীবী তাঁর পাসপোর্ট জমা দিতে সিবিআই দফতরে যান। কিন্তু তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়, মন্ত্রীকে নিজেকে এসেই জমা দিতে হবে পাসপোর্ট। তবে মদনের পারিবারিক সূত্রের খবর, মন্ত্রীর শরীরের যা অবস্থা, তাতে তিনি এখন সিবিআইয়ের কাছে যেতে পারবেন না। একটু সুস্থ হয়েই তিনি নিজে গিয়ে পাসপোর্ট জমা দিতে যাবেন।

madan mitra fit sskm home
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy