মিষ্টিমুখ। মন্ত্রিসভার রদবদল অনুষ্ঠানে বিদায়ী রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
এক মাসের নির্বাসন শেষ! মন্ত্রিসভায় শুধু ফিরলেনই না আসানসোলের মলয় ঘটক, দায়িত্ব পেলেন শ্রম দফতরের। যার অর্থ, আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী ও দলের শ্রমিক সংগঠনের নেত্রী দোলা সেনকে এ বার যাবতীয় দাবিদাওয়া নিয়ে দরবার করতে হবে মলয়বাবুর কাছে!
নতুন সমবায় মন্ত্রী হলেন পূর্ব মেদিনীপুরের জ্যোতির্ময় কর। দুই মেদিনীপুরে একাধিক সমবায় ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ এখন শুভেন্দু ও শিশির অধিকারীদের হাতে। তাঁদের মাথার উপরে এ বার থেকে মন্ত্রী হিসেবে থাকবেন জেলায় অধিকারী শিবিরের বিরোধী বলে পরিচিত জ্যোতির্ময়বাবু!
স্বাস্থ্য (আয়ুষ) দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হয়ে এলেন রামপুরহাটের আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। একই সঙ্গে তিনি উচ্চ শিক্ষা ও স্কুল শিক্ষা দফতরের প্রতিমন্ত্রীও হয়েছেন। যার ফলে কিঞ্চিত্ চাপে রাখা যাবে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। বীরভূমে তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের উল্টো শিবির তথা সাংসদ শতাব্দী রায়ের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত আশিসবাবু। যার অর্থ, জেলা নতুন মন্ত্রী পেলেও রাশ অনুব্রতর হাতে রইল না।
এখানেই শেষ নয়, এ দিন রদবদলের পরে দলীয় বৈঠকে অনুব্রত এবং বিধায়ক মনিরুল ইসলামকে মৃদু তিরস্কারও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। নাম না-করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের কিছু অসতর্ক কার্যকলাপের জন্য দলকে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে।
লোকসভা ভোটের পর থেকে দফতরবিহীন হয়ে-থাকা সুব্রত সাহা এ বার মন্ত্রিত্ব থেকেই বাদ। মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে তার ফলে মন্ত্রিসভায় কোনও প্রতিনিধিই রইলেন না।
অন্য দিক থেকে দেখলে, সুব্রতবাবুকে সরিয়ে ওই জেলায় হুমায়ুন কবীরকে ছড়ি ঘোরানোর সুযোগও করে দেওয়া হল।
তাঁর নিজের কথায়, ‘ছোট্ট রদবদল’। কিন্তু তার মধ্যে দিয়েই এ ভাবে নিজের মনোভাব স্পষ্ট করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যার রেশ চলল রদবদলের পরে দলীয় বৈঠকেও। সেখানে দলীয় কোন্দলের প্রসঙ্গ তুলে তিনি তীব্র ভর্ত্সনা করেন মালদহের দুই বিবদমান নেতানেত্রী তথা রাজ্যের দুই মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র ও কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী। সাবিত্রীদেবী এ দিনও কোনও দফতর পাননি। ফলে মুষড়ে ছিলেন আগাগোড়া। একই ভাবে সিন্ডিকেট-সংঘর্ষের জন্য তিরস্কৃত হয়েছেন সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার ও বিধায়ক সব্যসাচী দত্তও। বারবার সতর্ক করার পরেও নেতা-নেত্রীরা কাজিয়া বন্ধ না করলে তিনি চরম পদক্ষেপ করতে বাধ্য হবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন তৃণমূল নেত্রী।
রদবদল ও পরবর্তী দলীয় বৈঠকে এ ভাবে দলীয় সমীকরণে প্রয়োজনীয় একগুচ্ছ বার্তা দিয়ে রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রশাসনিক পদক্ষেপের চেয়েও যে সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক তাগিদই বেশি স্পষ্ট।
রাজভবনে নতুন মন্ত্রীদের শপথ হয়ে যাওয়ার পরেই এ দিন বিধানসভায় এসে মলয় ও আশিসবাবুকে মন্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মলয়বাবু ক’দিন আগেও মন্ত্রী ছিলেন। আশিসবাবু এ দিন পর্যন্ত ছিলেন পরিষদীয় সচিব। কাজেই তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না! তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যায়, দুই জেলায় দলীয় সমীকরণ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর যে উদ্বেগ ছিল, তা থেকে স্বস্তি পাওয়ার ইঙ্গিতই ধরা পড়েছে তাঁর ওই কাজে।
আসানসোলে বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়ের কাছে দলের শ্রমিক সংগঠনের নেত্রী দোলার শোচনীয় হারের পরে মলয়বাবুকে কৃষি দফতর থেকে সরতে হয়েছিল। সেই দায়িত্ব তখন দেওয়া হয় হাওড়ায় বিপুল ব্যবধানে জয় ছিনিয়ে আনার কারিগর অরূপ রায়ের হাতে। কিন্তু মন্ত্রিত্ব চলে গেলেও মলয়বাবু নিজেকে বিপ্লবী হিসেবে প্রতিপন্ন করতে যাননি। প্রকাশ্যে এবং আনন্দবাজারে চিঠি লিখেও দলনেত্রীর প্রতি আস্থা অটুট রেখেছিলেন। সম্প্রতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারী আসানসোলে গিয়েছিলেন। তখন বিভিন্ন ভাবে দলীয় নেতৃত্ব বুঝিয়ে দেন, মলয়বাবুর পুনর্বাসন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সেটাই বুধবারের রদবদলে হয়ে গেল।
আবার দোলাকে আসানসোলে প্রার্থী করা (যার বিরোধিতা মলয় করেছিলেন বলেই গোলমালের সূত্রপাত) যে ভুল হয়েছিল, মলয়বাবুকে সসম্মানে ফিরিয়ে এনে তৃণমূল নেত্রী প্রকারান্তরে তা-ই মেনে নিলেন! দোলা-ঘনিষ্ঠ পূর্ণেন্দু বসুকে সরিয়ে মলয়বাবুর হাতে শ্রম দফতর তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তেও এই বার্তা স্পষ্ট। দলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের লড়াইয়ে এই জয় উদ্যাপন করতেই এ দিন বিকেলে আসানসোলে মিছিল করেছেন মলয়-অনুগামীরা!
মন্ত্রিসভায় রদবদলের পরে বিকেলে তৃণমূল ভবনে দলীয় বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন, পূর্ণেন্দুবাবুর সঙ্গে কথা বলেই তিনি শ্রম দফতরে মুখ বদল করেছেন। বিক্ষুব্ধ হয়ে কোনও মন্ত্রীও এ দিন মুখ খোলেননি। পূর্ণেন্দুবাবুকে এখন থেকে কৃষি দফতরের ভার দেওয়া হল।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় পটাশপুরের বিধায়ক জ্যোতির্ময়বাবু অধিকারী পরিবারের ‘কাছের লোক’ বলে কোনও দিনই পরিচিত নন। পরিষদীয় সচিব থেকে তাঁর মন্ত্রিত্বে উন্নীত হওয়ার দিনে শুভেন্দু মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছেন। বলেছেন, ওই মন্ত্রীর কেন্দ্র তাঁর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে না। আবার জেলার কার্যকরী সভাপতি অখিল গিরি খুশি গোপন করেননি! দুর্ঘটনায় আহত জ্যোতির্ময়বাবু কপালে-মুখে একাধিক লিউকোপ্লাস্ট নিয়ে এ দিন রাজভবনে এসেছিলেন কোলাঘাট ও চণ্ডীপুরের দুই বিধায়ক বিপ্লব রায়চৌধুরী এবং অমিয় ভট্টাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে। দুই বিধায়কের কেউই অধিকারী পরিবারের অনুগামী বলে খ্যাত নন!
দলের একাংশের আপত্তি উপেক্ষা করেই বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রে মমতা প্রার্থী করেছিলেন নূরে আলমের স্ত্রী মমতাজ সংঘমিতাকে। পত্নী সাংসদ হয়ে যাওয়ার পরে এ বার পতির মন্ত্রিত্বের ইনিংসই ফুরিয়ে গেল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy