Advertisement
১৮ মে ২০২৪

প্রয়াত হালিম মেলালেন মমতা-বুদ্ধ-মুকুল-কেশরীকে

বিধানসভায় তাঁর বিরুদ্ধেই অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে বিরোধীরা। তুলকালাম বির্তকে তাঁর মুণ্ডপাত হয়েছে বিস্তর। স্পিকারের চেয়ারের দায়িত্ব হিসাবে তিনিই সে সব সামলেছেন। যখন তাঁর জবাবের পালা এল, বিরোধীদের উদ্দেশে বার্তা দিলেন— আমার সমালোচনা করছেন, করুন।

হাসিম আব্দুল হালিমকে শ্রদ্ধা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের। দেবস্মিতা ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

হাসিম আব্দুল হালিমকে শ্রদ্ধা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের। দেবস্মিতা ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৬
Share: Save:

বিধানসভায় তাঁর বিরুদ্ধেই অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে বিরোধীরা। তুলকালাম বির্তকে তাঁর মুণ্ডপাত হয়েছে বিস্তর। স্পিকারের চেয়ারের দায়িত্ব হিসাবে তিনিই সে সব সামলেছেন। যখন তাঁর জবাবের পালা এল, বিরোধীদের উদ্দেশে বার্তা দিলেন— আমার সমালোচনা করছেন, করুন। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্র যাতে ভঙ্গুর না হয়ে পড়ে, দেখার দায়িত্ব আপনাদেরই!

সংসদীয় গণতন্ত্রকে ভঙ্গুর না হতে দেওয়ার জন্যই যে তাঁর সারা জীবনের লড়াই ছিল, এক বাক্যে মানছেন তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরাও। তাই সোমবার সকালে পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা দেশের যে কোনও রাজ্যের বিধানসভার ইতিহাসে দীর্ঘতম সময় স্পিকারের ভূমিকা পালন করে আসা হাসিম আব্দুল হালিমের অকস্মাৎ প্রয়াণে দলীয় ভেদাভেদ ভুলে একই রকম মুহ্যমান হয়ে পড়লেন সব শিবিরের রাজনৈতিক নেতারা। কঠোর হাতে বিধানসভার অধিবেশন সামলানোর পাশাপাশি বিরোধী শিবিরের নেতাদের সঙ্গে মসৃণ ব্যক্তিগত সৌজন্য বজায় রাখার যে নৈপুণ্য হালিম দেখাতে পেরেছিলেন, ঠিক এই সময়ের রাজ্য রাজনীতিতে তা সম্ভবত বিরল! সেই স্মৃতি মাথায় রেখেই এ দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মুকুল রায় থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বিমান বসু থেকে মানস ভুঁইয়া প্রিয়জন হারানোর বেদনা অনুভব করার কথা বলেছেন।

হাসিম আব্দুল হালিমের প্রয়াণে কার কী শোকবার্তা পড়তে ক্লিক করুন

বয়স হয়েছিল ৮০। স্পিকার থাকার শেষ দিকেই শ্বাসকষ্ট সামলাতে নিজের কক্ষে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখতে হতো। তবু গুরুতর অসুস্থ ছিলেন না। বরং, রাজ্যে গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াইয়ে নানা মঞ্চে প্রতিবাদে সামিল হতেন। দু’দিন আগেই দেখতে গিয়েছিলেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার, অসুস্থ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। বাড়িতে এ দিন সকালে হঠাৎই শ্বাসকষ্টের বাড়াবাড়ি হয়েছিল। পরে বোঝা যায়, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন হালিম। চিকিৎসক-পুত্র ফুয়াদ হালিম জানিয়েছেন, রয়ে়ড স্ট্রিটের একটি নার্সিং হোমে নিয়ে গিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। ছোট মেয়ের বিদেশ থেকে ফেরার অপেক্ষায় এ দিন বাড়িতেই রেখে দেওয়া হয়েছে হালিমের মরদেহ। আজ, মঙ্গলবার দুপুরে প্রথমে তাঁর তিন দশকের কর্মক্ষেত্র বিধানসভা, তার পরে সিপিএমের রাজ্য দফতর আলিমুদ্দিন স্ট্রিট হয়ে মরদেহ পিপল্স রিলিফ কমিটির দফতরে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে গোবরা কবরস্থানে শেষকৃত্য।

পেশায় হালিম ছিলেন আইনজীবী। প্রথম বামফ্রন্ট সরকার ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তাঁকে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সিপিএম নেতৃত্বের মতে, সরকারের সেই প্রথম লগ্নে যে সব আইন বাম জমানার অভিজ্ঞান হয়ে আছে, তার সবই হয়েছিল হালিমের হাত ধরে। এর পরে ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় বার সরকার আসার পর থেকেই হালিম চলে গেলেন স্পিকারের দায়িত্বে। ২০১১ সালে বাম সরকারের বিদায় লগ্ন পর্যন্ত টানা ২৯ বছর ওই দায়িত্বে থেকে রেকর্ড গড়েছেন তিনি! সাবলীল ইংরেজি এবং বাংলায় বিধানসভা শাসন করতেন। সরকার পক্ষের বেঞ্চে গোলমাল দেখলে নীরব থাকতেন না! বিরোধীদের দাবির মুখে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্নোত্তর বা সভায় বিবৃতির জন্য তলব করার হিম্মত রাখতেন! আর গুলে খেয়েছিলেন পরিষদীয় আইনকানুন। তাই মৃত্যুর আগের রাত পর্যন্তও বিল এবং আইনের ব্যাখ্যা বুঝতে ফোন ধরে যেতে হয়েছে ‘হালিম স্যর’কে!

স্পিকারের ভূমিকায় দক্ষতার জন্য কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যানের শিরোপাও জুটেছিল তাঁর। হালিমের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, বিধানসভার রেকর্ডারের তথ্যবিদ দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘স্পিকার হিসাবে এতটাই পারদর্শী ছিলেন তিনি যে, অন্য স্পিকারেরা তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন।’’ যে কথার প্রতিধ্বনি ধরা পড়েছে এ দিন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর শোকবার্তায়। উত্তরপ্রদেশের স্পিকার থাকাকালীন ত্রিপাঠী বুঝেছিলেন, হালিম কে! এর বাইরেও আরও একটা পরিচিতি ছিল হালিমের। যে কথা বলেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু— ‘‘সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসাবে তাঁর পরামর্শ তো পেয়েছিই। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নেও সব সময় অবিচল ও দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন।’’

কোন বিধায়কের স্ত্রী অসুস্থ, কার কলকাতায় ঠাঁই জরুরি, এ সব ঠোঁটস্থ ছিল হালিমের। মুখ্যমন্ত্রী মমতার তরফে শোকবার্তা নিয়ে এ দিন প্রাক্তন স্পিকারের বাড়িতে গিয়ে তাই বিরোধী দলনেতা থাকার দিনগুলোর স্মৃতি মনে প়ড়ছিল পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের। মনে পড়ছিল, অধিবেশনে তুমুল তর্কের পরে কী ভাবে স্পিকারের ঘরে সমাপ্তি হতো তিক্ততার। শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে কংগ্রেসের মানসবাবু বলেই দিয়েছেন, ‘‘কমিউনিস্ট হয়েও এত বড় সংসদীয় ব্যক্তিত্ব, ভাবা যায় না!’’

জীবদ্দশায় একটাই বির্তক মাঝে মাঝে তাড়া করত তাঁকে। স্পিকার হয়েও দলের রাজ্য কমিটির সদস্যপদটা ছাড়েননি! প্রশ্ন করলে অবশ্য বলতেন, ‘‘আমি স্পিকার থাকতে দলের কোনও মিটিংয়ে মঞ্চে উঠিনি, ব্রিগেডে গিয়ে মাঠে বসে থেকেছি। দলের মিছিলেও হাঁটিনি।’’ আজ দল তাঁর মরদেহ নিয়ে হাঁটবে শোক-মিছিলে!

আনন্দবাজার আর্কাইভে হাসিম আব্দুল হালিম
সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

hashim abdul halim mukul roy mamata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE