আরও উচ্চগ্রামে উঠল তৃণমূলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-মুকুল রায় দ্বৈরথ! এ বার আসরে নামলেন বীজপুরের দলীয় বিধায়ক, মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু রায়। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর আক্রমণের তির সরাসরি দলনেত্রী মমতার দিকেই!
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুলের ডানা ছাঁটার কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করেছেন মমতা। সদ্য বৃহস্পতিবারই দলীয় বৈঠকে স্পষ্ট বলেছেন, আঁচড় দিতে এলে বাঘের নখও তিনি উপড়ে নিতে জানেন। ডানা ছেঁটে নখ উপড়ে দলের যে অংশকে তৃণমূল নেত্রী এখন সবক শেখাতে চাইছেন, তাদেরই প্রতিনিধি হয়ে শুক্রবার অবতীর্ণ হন শুভ্রাংশু। কল্যাণীতে তৃণমূলের ভোট কমার জন্য মুকুল-শিবিরের দিকে আঙুল উঠলে মমতার খাস তালুক ভবানীপুর বিধানসভা এলাকায় গত লোকসভা ভোটে দলের পিছিয়ে পড়ার দায় কার, সরাসরি এই প্রশ্ন তুলে একেবারে বাঘের ল্যাজেই পা দিয়েছেন শুভ্রাংশু! নিখাদ তথ্য দিয়ে যে পাল্টা প্রশ্ন মুকুল-পুত্র তুলেছেন, পরিসংখ্যান দিয়ে তা খণ্ডন করার কোনও উপায় তৃণমূল নেতৃত্বের নেই। কিন্তু প্রশ্নটা যেখানে দলনেত্রীকে চ্যালেঞ্জের, সেখানে চুপ করে বসে থাকাও চলে না! তাই দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি দিনতিনেকের মধ্যে বীজপুরের বিধায়কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করতে চলেছে বলে এ দিন ইঙ্গিত দিয়েছেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
উপনির্বাচনে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের বিপুল ব্যবধানে জিতলেও কল্যাণী বিধানসভা এলাকায় গত বছরের তুলনায় ভোট কমেছে তৃণমূলের। তৃণমূল নেত্রীর দৃঢ় ধারণা, দলের মধ্যে অন্তর্ঘাতই কল্যাণীতে এমন ফলের কারণ। দলীয় নেতৃত্বের কাছে মমতা ইঙ্গিত দিয়েছেন, কারা কোথায় কী করেছে, তিনি জানেন। দলের মধ্যে থেকে দলের ক্ষতি করার চেষ্টা তিনি বরদাস্ত করবেন না! অন্তর্ঘাতের ইঙ্গিত যে আসলে কাঁচরাপাড়ার রায়-বাহিনীর দিকেই, দলের অন্দরে তা বুঝতে কারও বাকি নেই! দলের একটি সূত্রের খবর, উপনির্বাচনের রাতেই মমতা এই নিয়ে মুকুলকে ফোনে অসন্তোষ জানান। মুকুল যেমন সে দিন নেত্রীর অভিযোগ মানতে চাননি, তেমনই এ দিন মুুকুল-পুত্র আরও এক ধাপ এগিয়ে দলনেত্রীকেই পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন! যে কথা শুনে দলের এক শীর্ষ নেতা বলছেন, “শুভ্রাংশু রাজনৈতিক ভাবে কতটা পরিণত, আমরা জানি! টিভি চ্যানেলকে ডেকে পুত্র যা বলেছেন, সেটা তো পিতার করে দেওয়া চিত্রনাট্য!” ঘনিষ্ঠ মহলে পিতাও পুত্রের সঙ্গে দ্বিমত হননি। তবে একই সঙ্গে তাঁর অভিমত, সব কথা সব সময় বলা যায় না। উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
বস্তুত, পিতার অমোঘ ছায়া পিছনে আছে বলেই পত্রপাঠ শুভ্রাংশুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি তৃণমূল নেতৃত্ব। কারণ, দলের কার্যবিধির ধারা-উপধারা মুকুলের মুখস্থ। তাড়াহুড়ো করে কোনও পদক্ষেপ করতে গেলে পাছে আইনের পাল্টা ব্যাখ্যায় মুকুলই উল্টে তাঁদের বিপাকে ফেলে দেন, এই সম্ভাবনা মাথায় রেখেই মেপে পা ফেলতে চাইছেন দলীয় নেতৃত্ব। দিল্লিতে বসে মুকুল অবশ্য পুত্রের মন্তব্য নিয়ে দাবি করেছেন, “এক জন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসাবে শুভ্রাংশুর নিজস্ব মতামত রয়েছে। আমি তাঁর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কোনও মন্তব্য করব না।”
দিদিকে বিঁধে ক্রিকেটে মন। শুক্রবার কাঁচরাপাড়ায়
মুরুল-পুত্র শুভ্রাংশু। সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
ঠিক কী বলেছেন শুভ্রাংশু? সোজা কথায়, কল্যাণীতে দলের বিরুদ্ধে কাজ করে ভোট কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। দিনভর নানা চ্যানেলে তিনি দাবি করেছেন, “কল্যাণীতে ভোট কমেছে। তবু দল সেখানে জিতেছে। গত লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে অনেক আসনে জিতলেও ভাটপাড়া, বিধাননগর, শ্রীরামপুরের মতো বিধানসভা আসনে দল পিছিয়ে পড়েছিল। দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ভবানীপুরেও দল পিছিয়েছিল। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে তো সকলের ক্ষেত্রেই হওয়া উচিত!”
গত বছরের লোকসভা ভোটের পরিসংখ্যান বলছে, শুভ্রাংশু যে সব উদাহরণ দিয়েছেন, সেই সবক’টি বিধানসভা আসনে বিজেপি-র তুলনায় পিছিয়ে পড়েছিল তৃণমূল। শুভ্রাংশু নিজে কল্যাণীর বিধায়ক নন। তবু তাঁকে যদি পাশের কেন্দ্রে ভোট কমার দায় নিতে হয়, তা হলে ভবানীপুরের বিধায়ক হিসাবে মমতা নিজেও একই তালিকায় পড়বেন না কেন কৌশলে এই প্রশ্নটাই তুলে দিয়েছেন শুভ্রাংশু। একেবারে বাবার কায়দায় নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহার করেছেন তথ্যকে। শুধু তাতেই থামেননি তিনি। মুকুলের ব্যাপারে প্রশ্ন শুনে ক্ষুব্ধ মমতা দিনকয়েক আগে বলেছিলেন, এ ব্যাপারে দলের কোনও ব্লক সভাপতি উত্তর দেবেন! দলনেত্রীর সেই তাচ্ছিল্যের জবাবে শুভ্রাংশু এ দিন বলেছেন, “বাবার জন্য আমি গর্বিত। রাজ্যে ৭৭ হাজার বুথের ৭৭ হাজার কর্মীকে বাবা চেনেন। যে কোনও ব্লক সভাপতিকে জিজ্ঞাসা করলেই এটা জানা যাবে!” একই সঙ্গে তিনি জানিয়ে রেখেছেন, “বাবার সম্মানহানি নিশ্চয়ই হচ্ছে! দলকে ভালবাসি।
কিন্তু বাবা এবং পরিবারের সম্মান সবার আগে। পুত্র হিসেবে বাবার পাশেই থাকব।”
শুভ্রাংশুর এমন বিস্ফোরণের খবর জেনে তৃণমূলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি এ দিন প্রাথমিক আলোচনায় বসে। পরে ওই কমিটির অন্যতম সদস্য পার্থবাবু বলেন, “নেত্রীর উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, দলের সিদ্ধান্ত নিয়ে বাইরে কথা বলা যাবে না। বীজপুরের বিধায়ক যে ভাষায় কথা বলেছেন, তাতে দলীয় লাইনের নির্দেশিকা লঙ্ঘিত হয়েছে।” বৈদ্যুতিন মাধ্যমে শুভ্রাংশুর বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপিং ও সংবাদপত্রে তাঁর বক্তব্য নিয়ে তিন দিন পরে ফের কমিটি বৈঠক করবে বলে পার্থবাবু জানান। তাঁর কথায়, “ওই বিধায়কের বক্তব্য খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দলকে সুপারিশ করবে কমিটি।”
মুকুলও দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির অন্যতম সদস্য। কমিটি তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে কি না, সেই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে পার্থবাবু এ দিন বলেন, “দলে কে কী করবে, তা স্থির করার দায়িত্ব আমাদের উপরেই ছেড়ে দিন! যাঁরা কলকাতায় রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যাঁরা বাইরে রয়েছেন, ফোনে তাঁদের সঙ্গেও কথা হয়েছে।” মুকুলকে নিয়ে দলের আর এক বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “পার্টিতে এমন অনেক কিছু হয়! আমরা কাউকে বার করে দিইনি। আর ও (মুকুল)-ও দল ছেড়ে যায়নি!” কিন্তু মুকুলকে নিয়ে জল্পনায় দলের ক্ষতি হচ্ছে কি না জানতে চাইলে, তিনি বলেন, “এটা মনে রাখতে হবে, কারও জন্য কিছু থেমে থাকে না!”
তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থার ইঙ্গিত নিয়ে শুভ্রাংশু অবশ্য বিশেষ কিছু বলতে চাননি। তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “কাগজ হাতে পাই। তার পরে যা বলার বলব!” জল্পনা উস্কে দিয়ে এ দিনই দিল্লিতে মুকুলের ১৮১, সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাংলো (যা আসলে দিল্লিতে তৃণমূলের কার্যালয়) থেকে মমতার ব্যবহারের জিনিসপত্র প্রকাশ্যেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পাশের বাংলোয়। সরকারি ভাবে যা যুবরাজ-সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলো। প্রতীকী এই হস্তান্তরের মাঝেই শুভ্রাংশুর মন্তব্য, “দল যত দিন রাখবে, তত দিন সৈনিক হিসেবে কাজ করব!”
এখন প্রশ্ন, পলক প্রথম ফেলবে কে? কী হবে শেষ অঙ্কে? বহিষ্কার না বিচ্ছেদ?