Advertisement
E-Paper

নিজের কাটা পা দেখে পরের ট্রেনে গলা

সামনে পড়ে নিজেরই দু’টো পা। হাঁটুর নীচ থেকে কাটা! আর লাইনের পাশে পড়ে কাতরাচ্ছেন পায়ের মালিক। কখনও বলছেন, ‘‘বাঁচান, আমাকে বাঁচান।’’ পরক্ষণে কাটা পায়ের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠছেন— ‘‘বেঁচে থেকে কী লাভ! সব তো শেষ!’’

শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৬ ০৪:০৬
স্বামীর মৃত্যুর খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মিঠু পাল।- বিতান ভট্টাচার্য

স্বামীর মৃত্যুর খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মিঠু পাল।- বিতান ভট্টাচার্য

সামনে পড়ে নিজেরই দু’টো পা। হাঁটুর নীচ থেকে কাটা! আর লাইনের পাশে পড়ে কাতরাচ্ছেন পায়ের মালিক। কখনও বলছেন, ‘‘বাঁচান, আমাকে বাঁচান।’’ পরক্ষণে কাটা পায়ের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠছেন— ‘‘বেঁচে থেকে কী লাভ! সব তো শেষ!’’

সত্যিই সব শেষ হয়ে গেল মিনিট পনেরোর ফারাকে। যখন একই লাইনে আসা অন্য ট্রেনের সামনে গলা বাড়িয়ে দিলেন লাল্টু পাল (৩৯) নামে যুবকটি। আলাদা হয়ে গেল ধড়-মুন্ডু।

সোমবার সকালে শিয়ালদহ-রানাঘাট শাখার হালিশহর স্টেশনে এ হেন এক মর্মন্তুদ দৃশ্যের সাক্ষী রইলে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো বহু মানুষ। তার আগে অবশ্য কিছু যাত্রী কেবিনম্যান-স্টেশন ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে বলেছিলেন, ওই লাইনে আসতে চলা পরের ট্রেনটিকে যেন আটকানো হয়। চেয়েছিলেন স্ট্রেচার। কয়েক জন লাইনে নেমে লাল্টুকে খানিকটা সরিয়েও এনেছিলেন। কিন্তু সে সব কাজে আসেনি। যাত্রীদের একাংশের অভিযোগ, রেল-কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হলে মৃত্যু হয়তো এড়ানো যেত।

পরে এই ক্ষোভ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। হালিশহর স্টেশনে আসা পরের ট্রেনটি আটকে দেয় জনতা। স্টেশন ম্যানেজার ঘেরাও হন। বিকেলে শিয়ালদহ রেল-পুলিশের সুপার দেবাশিস বেজ বলেন, ‘‘প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। দেখা হচ্ছে, ঠিক কী হয়েছিল।’’

কী হয়েছিল?

রেলের কর্তারা অবশ্য পরের ট্রেনে মাথা দেওয়ার ঘটনা অস্বীকার করছেন। ‘‘দ্বিতীয় বার ধাক্কার কোনও ঘটনাই ঘটেনি।’’— দাবি পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্রের। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান একেবারে উল্টো। কী রকম?

তাঁরা জানাচ্ছেন, এ দিন সকাল পৌনে ন’টা নাগাদ দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্ত দিয়ে লাইন পেরোচ্ছিলেন লাল্টু। ডাউন শান্তিপুর লোকালের ধাক্কায় তিনি লাইনের বাইরে ছিটকে পড়েন, পা দু’টো ঢুকে যায় লাইনের ভিতরে। দু’টো পা-ই হাঁটুর তলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ট্রেন বেরিয়ে যাওয়ার পরে দৃশ্যটি দেখে লোকজন গোড়ায় হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন। সম্বিৎ ফিরতে কিছু নিত্যযাত্রী স্টেশন ম্যানেজারের ঘরের দিকে দৌড়ান, যাতে লাইনে আর ট্রেন না-আসে। কেউ কেউ ছোটেন কেবিনম্যানের ঘরে। দু’-তিন জন লাল্টুর কাছেও পৌঁছে যান। লাইনের একদম ধার ঘেঁষে পড়ে থাকা যুবকটিকে তাঁরা ধরাধরি করে একটু সরিয়ে আনেন। এ দিকে ততক্ষণে খবর হয়ে গিয়েছে, ওই এক নম্বর লাইনেই ঢুকছে ডাউন গেদে লোকাল।

ট্রেনটিকে আটকানোর দাবিতে তখন স্টেশন ম্যানেজার ও কেবিনম্যানের ঘরে প্রবল চিৎকার-চেঁচামেচি। কয়েক জন স্ট্রেচার আনতে যান। ইতিমধ্যে আপ কল্যাণী লোকাল এসে দাঁড়ায় দু’নম্বর লাইনে। খানিক বাদে দেখা যায়, এক নম্বর প্লাটফর্মের দিকে ধেয়ে আসছে সেই ট্রেন— ডাউন গেদে লোকাল।

সকলে ধরে নিয়েছিলেন যে, এত কাণ্ডের পরে ট্রেন নিশ্চয় আর এগোবে না। কিন্তু দেখা যায়, গতি কিছুটা কমিয়েও ট্রেন শেষমেশ প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই পড়েছে! লাল্টুর কাছে যাঁরা ছুটে গিয়েছিলেন, এমতাবস্থায় তাঁরা পড়ে যান আপ-ডাউন লাইনের দু’টো ট্রেনের মাঝে। ওঁরা নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর তখনই লাল্টু তাঁর পুরো শরীরটা এক নম্বর লাইনের উপরে হেলিয়ে দেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি। ডাউন গেদে লোকাল চলে যায় তাঁর ঘাড়ের উপর দিয়ে। নিমেষে ধড় থেকে মাথা আলাদা হয়ে যায়। হালিশহরের সুভাষ সরণির বাসিন্দা লাল্টু ছিলেন পুরসভার অস্থায়ী কর্মী। দুধ ফেরিও করতেন। অভাবের সংসারে স্ত্রী ও বছর সাতেকের মেয়ে। দাদা গিরিধারীবাবু এসে ভাইয়ের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হতবাক নিত্যযাত্রীরাও। প্রত্যক্ষদর্শী অরিন্দম সরকারের কথায়, ‘‘ওঁর জ্ঞান ছিল। নিজের কাটা পা দেখে চিৎকার করে কাঁদছিলেন। বলছিলেন, আমার সব শেষ হয়ে গেল, বেঁচে থেকে আর কী করব!’’

কেউ কিছু করে ওঠার আগে সত্যি যে ভাবে সব শেষ হয়ে গেল, তাতে কিন্তু উঠে গিয়েছে বড় প্রশ্ন— দুর্ঘটনার খবর পেয়েও পরের ট্রেন আটকানো গেল না কেন? অনেকে বলছেন, আরও বেশি যাত্রী লাইনে নেমে পড়লে হয়তো এমনিতেই ট্রেন থেমে যেত।

এখন অবশ্য আক্ষেপই সার।

MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy