দিন কয়েক আগেও এটাই ছিল মন্দারমণির চেনা ছবি। —ফাইল ছবি।
অগস্ট ২০০৬। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদে অভিযোগ এল মন্দারমণির সমুদ্র সৈকতে কোনও রকম অনুমতি ছাড়াই বেশ কয়েকটি হোটেল গড়ে উঠছে। হোটেল করতে গিয়ে সমুদ্র সৈকতের কেয়া গাছের বন ধ্বংস করা হয়েছে, লাল কাঁকড়াদের বাসস্থান আক্রান্ত, আক্রান্ত সমুদ্র সৈকতের বাস্তুতন্ত্র, ভেঙে পড়েছে সমুদ্র সৈকতের প্রকৃতিক পরিবেশ।
বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ হোটেলগুলি বন্ধ রাখার আদেশনামা জারি করে সে সময়ই। কিন্তু লাভ হয়নি। দশ বছর পেরিয়ে মন্দারমণির অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। সে দিন ছিল মাত্র ছ’টি হোটেল ও বিলাসবহুল রিসর্ট। আজ সেই সংখ্যাটা ৫৩।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে হোটল মালিকরা আপিল আদালতে মামলা করেছিলেন। কিন্তু বিচারক গীতেশরঞ্জন ভট্টাচার্য-সহ আপিল আদালতের কারিগরি সদস্যরা পর্ষদের নিষেধা়জ্ঞাকেই মান্যতা দেন। সেইসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ সুরক্ষা আইন অমান্য করার দায়ে হোটেলগুলি ভেঙে দেওয়ার আদেশ জারি করেন।
কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯১ সালে সৈকত পরিবেশের সুরক্ষায় একটি বিশেষ আইন করে। সেই আইন অনুযায়ী বছরের বৃহত্তম জোয়ারের (হাই টাইড) জল সমুদ্রতটের ভিতরে যেখানে স্পর্শ করে, তার পরেও ৫০০ মিটার এলাকার মধ্যে কোনও রকম নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, তট লন্ডভন্ড করে হোটেল গড়ে তোলার এক অশুভ প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে মন্দারমণিতে।
ঠিক সময়ই আপিল আদালতের নির্দেশ পৌঁছেছিল জেলা প্রশাসন ও পুলিশের কাছে। কিন্তু প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ ইতিমধ্যেই গোটা বিষয়টিতে ছড়িয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন নামক এক ভাইরাস। তারই জেরে এখনও দ্রুত লয়ে চলছে হোটেল তৈরির কাজ। অদ্ভুত ভাবে সমস্ত আইনকে অগ্রাহ্য করে আরও অনেক হোটেল তৈরি হয়েছে গত দশ বছরে। এই পরিস্থিতিতে আপিল আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হোটেল মালিকরা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। কলকাতা হাইকোর্ট হোটেলগুলি ভাঙার নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেয়। কিন্তু হোটেলগুলি চালু করার অনুমতি দেননি বিচারক।
সময় কেটে যায়। মন্দারমণির সমুদ্র সৈকতের ধ্বংসের খেলা দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। ২০০৮ সালে বিষয়টি ফের কলকাতা হাইকোর্টের নজরে আনা হয়। ২০০৮-এর ২৯ অগস্ট প্রধান বিচারপতি সমস্ত ধরনের হোটেলের কাজকর্ম বন্ধ রাখতে নির্দেশ জারি করে। কিন্তু একটি হোটেলও বন্ধ হয়নি। বরং সৈকতের উপর এমন জায়গায় হোটেল গড়ে উঠল যেখানে জোয়ারের সময় যাওয়াই যায় না। একমাত্র ভাঁটার সময় সৈকতের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে হোটেলে ঢুকতে হয়। এমন নজির পৃথিবীর কোথাও আছে বলে মনে হয় না।
২০০৯ সালে কলকাতা হাইকোর্ট ফের সমুদ্র রক্ষা করার পরিবেশ আইনকে কার্যকরী করতে নির্দেশ দেয়। হাইকোর্টের সেই আদেশ সর্ব সবাইকে জানানোর জন্য বিজ্ঞাপিত করার আদেশও জারি হয়। কিন্তু লাভ হয়নি। রামনগর থানায় হোটেল মালিকদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ জানায় দূর্ষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। ততদিনে ছ’টি হোটেলের জায়গায় ৫৩টি হোটেল তৈরি হয়ে গিয়েছে। তদানীন্তন জেলাশাসকের রিপোর্টে প্রকাশ পায় হাইকোর্টের আদেশকে লঙ্ঘন করে কী ভাবে একের পর এক হোটেল তৈরি হয়েছে। সৈকত জুড়ে গাড়ির দাপাদাপি, হোটেলগুলির বর্জ্য সমুদ্র সৈকতে ছড়িয়ে পড়ছে— চলছে এক চরম ব্যভিচার।
২০০৬ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পরিবেশ আইন, হাইকোর্টের আদেশ ভেঙে গড়ে উঠল পরিবেশ দুর্নীতির এক অনন্য নজির। আজ মন্দারমণি এক মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে, যেখানে উদ্ধত যৌবন হারিয়ে যায় অন্ধকারে। ঠিক যে ভাবে মন্দারমণির সমুদ্র সৈকতে হারিয়ে গিয়েছে জীববৈচিত্র। আর সমুদ্র সৈকত দাঁড়িয়ে আছে পরিবেশ হত্যার বধ্যভূমি হয়ে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, আইন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার চরম পরিণতিতে মন্দারমণির সৈকত ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সরকার নীরব দর্শক।
(প্রাক্তন আইন আধিকারিক, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy