Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Annapurna Puja

মঙ্গলকাব্যের প্রভাবেই বাংলায় শুরু হয় অন্নপূর্ণা আরাধনা

অন্ন দিয়ে যিনি দারিদ্র্য, দুঃখ মেটান তিনিই অন্নপূর্ণা। এখনও পর্যন্ত অন্নপূর্ণার প্রাচীন কোনও মূর্তির সন্ধান না মেলায় গবেষকদের মতে, অন্নদামঙ্গল কাব্যের প্রভাবেই বাংলায় প্রসার ঘটেছিল এই পুজোর। জনশ্রুতি, নদিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার বাংলায় অন্নপূর্ণা পুজোর প্রচলন করেন।

ব্যারাকপুর অন্নপূর্ণা মন্দির, নিজস্ব চিত্র

ব্যারাকপুর অন্নপূর্ণা মন্দির, নিজস্ব চিত্র

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৭ ১৬:০১
Share: Save:

অন্ন দিয়ে যিনি দারিদ্র্য, দুঃখ মেটান তিনিই অন্নপূর্ণা। এখনও পর্যন্ত অন্নপূর্ণার প্রাচীন কোনও মূর্তির সন্ধান না মেলায় গবেষকদের মতে, অন্নদামঙ্গল কাব্যের প্রভাবেই বাংলায় প্রসার ঘটেছিল এই পুজোর। জনশ্রুতি, নদিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার বাংলায় অন্নপূর্ণা পুজোর প্রচলন করেন। শোনা যায় প্রাচীন কালে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতেও এই পুজো হত। এ ছাড়া কাশীর অন্নপূর্ণা মন্দির গোটা দেশে বিশেষ প্রসিদ্ধ।

ব্যারাকপুরের তালপুকুর অঞ্চলে রয়েছে একটি অন্নপূর্ণা মন্দির, যা দেখতে অবিকল দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের মতো। ১৮৪৭-এ রানি রাসমণি তাঁর জামাই মথুরমোহন বিশ্বাস, আত্মীয়স্বজন ও অসংখ্য দাসদাসীকে সঙ্গে নিয়ে কাশীযাত্রা করেছিলেন। রাতে নৌকায় তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পান, কাশী না গিয়ে গঙ্গার পূর্ব পাড়ে দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে নিত্যপুজোর ব্যবস্থা করতে। এর পরে রানি কাশীযাত্রা স্থগিত করে দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৮৫৫ সালে।

ব্যারাকপুর অন্নপূর্ণা মন্দিরের বিগ্রহ। নিজস্ব চিত্র

আরও পড়ুন- বদলাচ্ছে স্যুইটের নাম, রাজভবনে সাহেবিয়ানা মুছছেন কেশরী

শোনা যায়, কাশীর অন্নপূর্ণা দর্শনে বিঘ্ন ঘটায় সেই থেকেই রানি রাসমণির জামাই মথুরমোহন বিশ্বাসের মনে ইচ্ছে ছিল দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির প্রতিষ্ঠা করার। তাঁর জীবদ্দশায় না হলেও সেই স্বপ্নপূরণ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী, রানি রাসমণির ছোট মেয়ে জগদম্বাদেবী। দক্ষিণেশ্বরে মন্দির প্রতিষ্ঠার ঠিক ২০ বছর পরে ১৮৭৫-এর ১২ এপ্রিল চাণক-এ অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। এই চাণকই হল আজকের ব্যারাকপুর। মন্দির প্রতিষ্ঠার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁদের পুত্র দ্বারিকানাথ বিশ্বাস। তৈরি হয়েছিল পঙ্খের কাজ যুক্ত ন’টি চূড়াবিশিষ্ট নবরত্ন মন্দির, বৃহৎ নাটমন্দির, ছ’টি আটচালার শিবমন্দির, দু’টি নহবৎখানা, গঙ্গার ঘাট, ভোগের ঘর ইত্যাদি। এতে সে যুগে খরচ হয়েছিল প্রায় তিন লক্ষ টাকা। ছ’টি শিবমন্দির যথাক্রমে কল্যাণেশ্বর, কাম্বেশ্বর, কিন্নরেশ্বর, কেদারেশ্বর, কৈলাসেশ্বর, ও কপিলেশ্বর।

ব্যারাকপুর অন্নপূর্ণা মন্দির। নিজস্ব চিত্র

দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের চেয়ে এই মন্দির উচ্চতায় কিছুটা বেশি হলেও দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে কিন্তু কম। মন্দিরে অধিষ্ঠিত শিব ও অন্নপূর্ণার বিগ্রহ অষ্টধাতুর তৈরি। দেবীকে পরানো হয় বেনারসী শাড়ি ও স্বর্ণালঙ্কার। দেবীর চালচিত্র ও সিংহাসন রুপোর তৈরি। প্রতি মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে বিশেষ পুজো হয়। মন্দিরে প্রতিদিন অন্নভোগ হয়। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, দেবী অন্নপূর্ণার ভোগে প্রতিদিন মাছ থাকা আবশ্যিক। মন্দিরে মূল অন্নকূট উৎসব হয় কালীপুজোর পরের দিন। এ ছাড়াও অন্নকূট হয় অন্নপূর্ণা পুজোর দিন। আগে পাঁঠাবলি হলেও এখন তা বন্ধ।

বড়িশার বড়বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

নাটমন্দিরের থামে গথিক স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তা ছাড়া, মন্দিরের আর্চে দেখা যায় সূক্ষ্ম অলঙ্করণ ও নকশা। কথিত আছে, মন্দিরের প্রবেশপথের তোরণের উপর যে সিংহটি রয়েছে, সেটি সরিয়ে ফেলার জন্য এক সময় ব্রিটিশ প্রশাসন মন্দিরের উপর নানা রকম চাপ সৃষ্টি করেছিল। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে আদালতের রায়ে সেটি যথাস্থানেই রয়ে গিয়েছিল।

খান বাড়ি, বলরাম দে স্ট্রিট। নিজস্ব চিত্র

মন্দিরের নিত্যসেবা ও পুজোপার্বণের ব্যয় বহনের জন্য জগদম্বাদেবী সেই সময়ে উপযুক্ত সম্পত্তি দিয়ে ‘অর্পণনামা’ করেছিলেন। সেই ‘অর্পণনামা’-র নির্দেশ অনুসারে ‘জ্যেষ্ঠানুক্রমে’ বংশের বয়োজ্যেষ্ঠকে মন্দিরের সেবায়েত হতে হয়। এই মন্দিরের সেবায়েত রাজশ্রী বিশ্বাস জানালেন, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পরে মন্দিরের আয় কমতে থাকে। দেবোত্তর এস্টেটের উদ্যোগে মন্দিরে নিত্যপুজো ও সেবা হলেও আর্থিক সমস্যা তৈরি হয় রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার নিয়ে। ঐতিহাসিক এই মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে আজও মেলেনি কোনও সরকারি সহায়তা। পুজো-পার্বণে ভক্ত সমাগম হলেও অন্যান্য দিনে খুব কম সংখ্যক মানুষের আনাগোনা এই মন্দিরে।

মিত্র বাড়ি, বিডন স্ট্রিট। নিজস্ব চিত্র

তেমনই অন্নপূর্ণার আরও একটি মন্দির রয়েছে বেহালার বড়িশায়। সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের চন্দ্রকান্ত রায়চৌধুরী তৎকালীন বড়িশা গ্রামে বড়বাড়ির মধ্যে ১৮৫০ সালে একটি পঞ্চরত্ন মন্দিরে অষ্টধাতুর দেবীমূর্তি এবং রুপোর শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দির প্রতি‌ষ্ঠার নেপথ্যে শোনা যায় এক কাহিনি। চন্দ্রকান্তের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁর দুই স্ত্রী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁরা কাশীবাসী হবেন। চন্দ্রকান্ত তাঁদের কাশী যাওয়া আটকাতে বাড়িতেই দেবীর মন্দির তৈরি করেন। দেবী অন্নপূর্ণা ছাড়াও জোড়া শিবের মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। একে বলে গৃহী শিবের মন্দির। পরে ১৯৫৬ সালে চন্দ্রকান্তের প্রতিষ্ঠিত অন্নপূর্ণা বিগ্রহটি চুরি হয়ে যায়। ১৯৬৮ সালে পুরনো মন্দির ভেঙে নতুন মন্দিরটি তৈরি করা হয়। এবং ১৯৬৯ সালে নতুন বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে মন্দিরের আংশিক সংস্কার করা হয়েছে। অন্নপূর্ণা পুজো উপলক্ষে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়।

কলকাতার কিছু বনেদি পরিবারেও প্রতিষ্ঠিত দেবী অন্নপূর্ণার বিগ্রহ রয়েছে। যেমন বিডন স্ট্রিটের ‘মিত্রাশ্রম’। অতীতে শিমুলিয়ার নিজ গ্রামে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বাড়িটি কিনেছিলেন বিশ্বনাথ মিত্র। পরে রাস্তাটির নামকরণ হয় বিডন স্ট্রিট। এই পরিবারের বধূ শিবসুন্দরী মিত্র ১৯০৪ সালে নীলকমলেশ্বর শিব ও দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। মূর্তিটি ম্যানচেস্টারের স্টুয়ার্ট কোম্পানি থেকে তৈরি করিয়ে আনা হয়েছিল।

তেমনই বলরাম দে স্ট্রিটের খান পরিবারের অন্নপূর্ণা পুজো এ বার ৬০ বছরে পা দিল। পুজো শুরু করেছিলেন বৈদ্যনাথ খান। পুজোর আগের দিন হয় অধিবাস। সাবেক প্রথা মেনে হয় ধুনো পোড়ানো, কুমারীপুজো এবং বালক ভোজন। সন্ধ্যায় হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ভোগে থাকে নানা রকমের পদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE