বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিকে ঢালাও ছাড়পত্র দিতে চায় কেন্দ্র। বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তারি কলেজ খুলতে নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছে তারা। কিন্তু এতে মুড়ি-মুড়কির মতো চিকিৎসক তৈরি হলেও, তাঁদের গুণগত মান কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যের চিকিৎসক মহল। নিজেদের এই আশঙ্কার কথা দিল্লির স্বাস্থ্য মন্ত্রককে লিখিত ভাবে জানিয়েছেন তাঁরা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রক ইতিমধ্যে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়াকে (এমসিআই) মেডিক্যাল কলেজ খোলার নিয়ম শিথিল করার অনুরোধ জানিয়েছে। কোনও কলেজে পঠনপাঠনের নামে বাণিজ্যিকীকরণের প্রমাণ পেলে, সেটির অনুমোদন প্রত্যাহারের যে নিয়ম রয়েছে, তা নিয়েও কিছুটা নরম থাকার আর্জি পেশ করা হয়েছে বলে মন্ত্রক সূত্রের খবর। আর এখানেই আপত্তি প্রবীণ চিকিৎসকদের।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনে করেন, এর ফলে পড়ুয়ার মেধার চেয়ে আর্থিক সামর্থ্যই গুরুত্ব পাবে বেশি। ডাক্তারি শিক্ষার মানের সঙ্গে আপস করার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অবশ্য দাবি, চিকিৎসকদের ঘাটতি মেটাতেই এমনটা ভাবছে কেন্দ্র। কিন্তু প়ড়াবেন কারা? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘সরকারি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক-চিকিৎসকের অভাব নিয়ে বিস্তর কথা কানে আসে। কিন্তু বাস্তবে বেসরকারি কলেজের হাল আরও খারাপ। বেশির ভাগ কলেজে পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নেই বললেই চলে। এমসিআই-এর পরিদর্শনের আগে কোনও ভাবে অন্য জায়গা থেকে ভাড়া করে আনা হয় শিক্ষক।’’
তাই এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের ঢালাও ছাড়পত্রে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁদের মতে, ক্লিনিক্যাল ট্রেনিং বিষয়টা এমনিতেই অবহেলিত। তার উপরে আরও আপস শুরু হলে ডাক্তারি-শিক্ষার হাল কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের এক প্রবীণ অধ্যাপকের কথায়, ‘‘বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা সরকারি হাসপাতালের তুলনায় অনেকটাই কম। তাই ‘বেড সাইড ট্রিটমেন্ট’ অর্থাৎ রোগীর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা শেখার বিষয়টা ওখানে বেশ অবহেলিত। বরং সরকারি হাসপাতালে সেই সুযোগটা বেশি। বিচিত্র সব সমস্যা নিয়ে রোগীরা আসেন। পড়ুয়ারাও অনেক বেশি শিখতে পারেন।’’
তবে চিকিৎসকের যে ঘাটতি রয়েছে, মানছেন অনেকেই। জাতীয় চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণকুমার অগ্রবাল বলেন, ‘‘মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বাড়াটা জরুরি। কিন্তু শিক্ষার মানের সঙ্গে আপস করলে তা আদতে সাধারণ মানুষের স্বার্থেই ঘা দেবে। সে ক্ষেত্রে ডাক্তার না-থাকা, আর খারাপ ডাক্তার থাকা— একই ব্যাপার। তাই কোথাও একটা শক্ত রাশ থাকা দরকার।’’
এ রাজ্যে বেসরকারি একটি মেডিক্যাল কলেজে ১৫০টি আসনের মধ্যে ৫০টি আসনে পড়ুয়ারা সরকারি ভাবে অর্থাৎ জয়েন্টের মাধ্যমে ভর্তি হন। ৭৭ জন ম্যানেজমেন্ট কোটায়, আর বাকি ২৩টি আসনে পড়ুয়ারা আসেন এনআরআই কোটায় —শুধু মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে। ম্যানেজমেন্ট কোটায় ভর্তির তদারকিতে সরকার নিযুক্ত কমিটি রয়েছে বটে, কিন্তু প্রশ্ন রয়েছে তাদের দায়বদ্ধতা নিয়েও। অভিন্ন প্রবেশিকা চালুর পরে পরিস্থিতি কিছুটা বদলের আশা থাকলেও আদতে ছবিটা কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে নিশ্চিত নন কেউই।
কেপিসি মেডিক্যাল কলেজের (রাজ্যের অন্যতম বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ) কর্ণধার চিত্তরঞ্জন মাইতির অবশ্য দাবি— ‘‘সরকারি নিযুক্ত কমিটিই ম্যানেজমেন্ট কোটায় ভর্তির তদারকি করে। এখানে কলেজের মতামত প্রকাশের জায়গা নেই।’’
কিন্তু সরকারি মেডিক্যাল কলেজেই যেখানে শিক্ষক-চিকিৎসকের ব্যবস্থা করতে নাভিশ্বাস উঠছে, সেখানে বেসরকারি কলেজ শিক্ষক জোগাড় করবে কোথা থেকে? চিত্তরঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘এমসিআই অবসরের বয়স ৭০ করায় বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলি সরকারি অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের নিয়োগ করছে। কিন্তু রাজ্য সরকারও যে ভাবে ক্রমশ অবসরের বয়স বাড়াচ্ছে, তাতে পরে কী হবে, জানা নেই।’’
তা হলে উপায়? এমসিআই-এর প্রাক্তন সদস্য, তথা ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর প্রাক্তন অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র মনে করেন, বেসরকারি কলেজগুলিকে ঢালাও ছাড়পত্র দেওয়ার চেয়ে বরং সরকারি কলেজগুলির অনুমোদন বা আসন বাড়ানোর নিয়ম শিথিল করা উচিত।
প্রদীপবাবুর অভিজ্ঞতায়, ‘‘এমসিআই-এর সদস্য হিসেবে একাধিক মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শন করেছি। কোথাও হয়তো গিয়ে দেখলাম, বেড অকুপেন্সি ৮০ শতাংশ। সন্দেহ হল। সারপ্রাইজ ভিজিটে গিয়ে দেখা গেল, মাত্র ২৫ শতাংশ। এমন মিথ্যাচার চললে পঠনপাঠনের মান ঠিক থাকবে কী ভাবে? বরং ডাক্তারের সংখ্যা যদি বাড়াতেই হয়, তা হলে ছোটখাটো কারণ দেখিয়ে সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলির অনুমোদন বাতিলের যে প্রবণতা, তা বন্ধ করতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy