শৌলা খালে ‘মা সন্তোষী’তে ছেলে ও নাতির সঙ্গে মীনাক্ষী। নিজস্ব চিত্র
গ্রামের মহিলারা ঘিরে ধরে গল্প শুনতে চাইতেন। মাঝ সমুদ্রের গল্প। যেখানে শুধু জল আর জল। যেখানে আনাজ কাটা নেই, ভাত রান্না নেই। আছে শুধু নিজের যন্ত্রচালিত নৌকা আর জাল। সঙ্গী কয়েকজন পুরুষ মৎস্যজীবী। তাঁদের সঙ্গে মাছ ধরছেন মীনাক্ষী। ঘর-গৃহস্থালীতে অভ্যস্ত মেয়েরা বিস্ময়ে প্রশ্ন করতেন, ‘‘কী করে পারো, দিদি!’’
মীনাক্ষী মানে মীনাক্ষী মান্না। মন্দারমণি উপকূল থানার দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুর গ্রামের বাসিন্দা মীনাক্ষী ভারতের প্রথম সমুদ্রে যাওয়া মহিলা মৎস্যজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। ছিলেন এক মৎস্যজীবীর স্ত্রী। স্বামীর দুর্বিপাকে যোগ্য সহধর্মিনীর মতো পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই সিদ্ধান্তই তাঁকে সংসার, সন্তান ডাঙায় ফেলে জলে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
গ্রামের একতলা পাকা বাড়ির দাওয়ায় বসে স্মৃতিচারণ করছিলেন মীনাক্ষী। ১৯৯৫ সাল। স্বামী নির্মল মান্নার ট্রলার ছিল। ট্রলার মানে যন্ত্রচালিত বড় ভুটভুটি। মাছ ধরার রেওয়াজ অনুযায়ী ট্রলারের চালক এবং মৎস্যজীবীদের বরাত দিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতেন নির্মলবাবু। কিন্তু ওই বছর তাঁর কাছ থেকে মোটা টাকা অগ্রিম নিয়ে পালিয়ে যায় ট্রলার চালক। মাছ ধরার মরসুমে সমুদ্রে একদিন না যাওয়া মানে বিরাট ক্ষতি। ট্রলার চালক না পেলে তো ক্ষতি আরও বেশি। সমুদ্রে মৎস্যজীবীদের ট্রলার চালকদের অভিজ্ঞতার ওপরে নির্ভর করতে হয়। মাছের ঝাঁকের কাছে ট্রলার যে তাঁরাই নিয়ে যান। একে ব্যবসার ক্ষতি। তার ওপর অতগুলো টাকা বেহাত হয়ে যাওয়ায় মুষড়ে পড়েছিলেন ঋণগ্রস্ত নির্মলবাবু।
মাছ ধরতে যাওয়ার কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না মীনাক্ষীর। তবুও স্বামীকে ভরসা জোগান তিনি। দু’একবার ট্রলারে চেপেছিলেন। সেই ভরসাতেই স্বামীকে বলেন, ‘‘চলো মাছ ধরতে। আমি ট্রলার চালাব।’’ নির্মলবাবু উৎসাহ দেখাননি। কিন্তু স্ত্রীর জেদের কাছে হার মানেন শেষ পর্যন্ত। তাঁদের তিন ছেলে, নন্দন, চন্দন ও বিনন্দন তখন বেশ ছোট। ছেলেদের আত্মীয়ের বাড়ি রেখে স্বামীর সঙ্গে ভেসে পড়েন সমুদ্রে। সেই সময়ে তাঁর সিদ্ধান্ত বিস্মিত করেছিল স্থানীয় মৎস্যজীবী সমাজকে। পড়শিদের তো বটেই। সেজন্যই মাছ ধরে ফিরলে মেয়েরা সমুদ্রের গল্প শোনার জন্য ঘিরে ধরতেন।
সাহস দেখিয়েছিলেন বলে স্বীকৃতিও মিলেছিল। দেশে এবং বিদেশে। ন্যাশনাল ফিশার ওয়ার্কার্স ফোরাম (এনএফএফ) মীনাক্ষীকে তাদের এগজিকিউটিভ বোর্ডে বিশেষ সাম্মানিক সদস্য পদ দিয়েছিল। এক মহিলার সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার খবর পৌঁছেছিল বিদেশেও। ২০০০ সালে নরওয়ের একটি বেসরকারি সংস্থা তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়, সেদেশে গিয়ে লড়াইয়ের ‘ডেমো’ দিতে। বিপাকে পড়লেন মীনাক্ষী। বিদেশ যাওয়ার টাকা কোথায়? তাছাড়া এক গ্রাম্য মৎস্যজীবী পরিবারকে ভিসা-পাসপোর্ট জোগাড় করে দেবে কে? সেই সময়ে সাহায্য করেছিলেন রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দ। এগিয়ে এসেছিল এনএফএফ। এই সংগঠনের দুই নেতা হরেকৃষ্ণ দেবনাথ এবং কেরলের মৎস্যজীবী নেতা টমাসের সঙ্গে নরওয়ে যান তিনি।
মাছ নরওয়ের জীবিকা এবং অর্থনীতির অন্যতম অবলম্বন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাছ রফতানিকারী দেশ নরওয়ে। মীনাক্ষী নরওয়ের অভিজ্ঞ মৎস্যজীবীদের মন জয় করে দেশে ফিরেছিলেন। ১৩ দিনের সফর ছিল। সমুদ্রে ট্রলার চালিয়ে মাছ ধরে দেখিয়েছিলেন। তাঁদের বাংলার মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রার কথা শুনিয়েছিলেন। আর মাছের টক রেঁধে খাইয়েছিলেন। হাসতে হাসতে সেই গল্প শোনালেন মীনাক্ষী। দেশ থেকে চাল নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই চালে ভাত রাঁধলেন। তারপর সমুদ্র থেকে নিজের ধরা মাছের তরকারি। শেষ পাতে বাংলার নিজস্ব মাছের টক। টক খেয়ে সেখানকার বাসিন্দারা আত্মহারা। দোভাষীর মাধ্যমে বারবার মাছের টকের কথা, তার রেসিপির কথা জানতে চাইছিলেন সেখানকার সংগঠনের মাথারা।
বাংলার আরও একটা জিনিসে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন নরওয়ের লোকেরা। কাঁথা। নরওয়ে ঠান্ডার দেশ। স্বাভাবিক ভাবেই দরিদ্র ভারতের এক দরিদ্র মৎস্যজীবী কীভাবে শীত আটকান তা জানার আগ্রহ ছিল। মীনাক্ষী জানিয়েছিলেন, শীতের অবলম্বন কাঁথা। এবার কাঁথা কী, কীভাবে তৈরি হয়, তা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন। ঘরের বাতিল কাপড় দিয়ে তৈরি কাঁথায় শীত আটকানো যায় শুনে অবাক তাঁরা। মীনাক্ষী দেশে ফেরার পরেও নরওয়ের ওই সংগঠনের লোকজনেদের কাঁথা নিয়ে মুগ্ধতা কাটেনি। মৎস্যজীবী ফোরামের মাধ্যমে কাঁথা চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মীনাক্ষী। তাই কাঁথার অনুরোধ রাখা সম্ভব হয়নি তাঁর।
জীবনে অনেক ওঠাপড়া দেখেছেন মীনাক্ষী। দেখেছেন নরওয়ে থেকে ফেরার পরে সংবর্ধনার ঢল। এলাকায় মেলা থেকে ক্লাবের অনুষ্ঠান, সব জায়গায় ডাক পড়ত মীনাক্ষীর। তাঁকে সম্মানিত করা হত। এখনও তাঁর বাড়িতে গেলে সেই সম্মান-স্মারকের দেখা মেলে। লড়াইয়ের দিনগুলো মনে রাখতে যত্ন করে রেখে দিয়েছেন সেগুলো। আবার দেখেছেন, সময় গড়াতে ফিকে এল সংবর্ধনার ঢল। তবে পাড়ায় এখনও লড়াকু মীনাক্ষীকে অন্য চোখেই দেখেন মেয়ে-বউরা। মীনাক্ষী শুধু নিজের সংসার বাঁচাতে লড়াই করেননি। লড়েছেন সহযোদ্ধা মৎস্যজীবীদের জন্য। মৎস্যজীবীদের দাবিদাওয়ার জন্য রাস্তায় নেমেছেন।
জীবনের লড়াই এখনও থামেনি মীনাক্ষীর। যে তিন ছেলেকে আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে সমুদ্রে গিয়েছিলেন তাঁদের এখন বিয়ে হয়েছে। পুত্রবধূ নাতি-নাতনিদের নিয়ে মোট পনেরো জনের সংসার। আগে স্বামী থাকতেন সঙ্গে। এখন মাছ ধরায় সঙ্গী হন ছেলেরাও। মাছ ধরার ভরা মরসুম আসছে। মীনাক্ষীর কথায়, “এখন প্রায় আড়াই মাস সমুদ্রে রোজ মাছ ধরা চলবে। বিন্ধা জালে পড়বে ছোট ছোট সামুদ্রিক মাছ। টুলা, তাপড়া, রুলি, ভোলা, দইচাক, কত ধরনের মাছ।’’ তার পরই আষাঢ় মাস। শুরু হবে ইলিশের মরসুম। পাতা হবে মনোফিল জাল। প্রতি ট্রিপে তিন থেকে চার দিন থাকতে হবে সমুদ্রে। মাছ ধরে দিঘা মোহনা এবং পেটুয়া ঘাটের বাজারে মাছ নিলাম করে ফিরবেন ডাঙায়।
যতটা সহজে সমুদ্র সফরের কথা বলা গেল মাছ ধরার কাজটা ততটা সহজ নয়। মাঝ সমুদ্রেও লড়াই আছে। মীনাক্ষীদের মাছ ধরার নৌকাকে ট্রলার বলা যায় না। সেটা যন্ত্রচালিত বড় নৌকা মাত্র। এখন মাঝ সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায় বড় বড় ব্যবসায়ীর অত্যাধুনিক ট্রলার। সেই ট্রলারের যন্ত্র খুঁজে দেয় মাছের ঝাঁক। বলে দেয়, কোনখানে কত স্পিডে ট্রলার চালাতে হবে। ওই ট্রলারই জাল ছিঁড়ে দেয় মীনাক্ষীদের মতো ভুটভুটি সম্বল মৎস্যজীবীদের।
তবু লড়তে হয় পঞ্চাশোর্ধ্ব মীনাক্ষীদের। এক দিন রাতে বেরিয়ে পড়তে হয় ভুটভুটি ‘মা সন্তোষী’কে নিয়ে। শৌলা খাল বেয়ে সন্তোষী ঝাঁপায় বঙ্গোপসাগরে।
জলেই যে জীবন মীনাক্ষীর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy