Advertisement
০৭ মে ২০২৪

সিনেমাহল ধ্বংসস্তূপ, ভরসা সেই কাঁথি

সময়টা ষাট-সত্তরের দশক। পুজোর মুখে নতুন বাংলা সিনেমা দেখতে লম্বা লাইন পড়েছিল শহরের নারায়ণ সিনেমা হলে। কিন্তু লাইনের তোড়ে সিনেমা দেখা দূর, টিকিটই মেলেনি দু’দিন ধরে। বাড়ির বারান্দায় বসে স্মৃতিচারণ করছিলেন বছর পঁচাশির শ্রীকান্তবাবু। এগরার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের এই বাসিন্দা স্মৃতিমেদুর গলায় তাই বলে ওঠেন, “অনেক দিন তো হল, সেই এগরা শহরও নেই, আর সিনেমা হলগুলো তো সব শিকেয় উঠেছে।”

এগরার রাজ্যশ্রী সিনেমা হলের হাল। হলের টিকিট (ইনসেটে)— নিজস্ব চিত্র

এগরার রাজ্যশ্রী সিনেমা হলের হাল। হলের টিকিট (ইনসেটে)— নিজস্ব চিত্র

কৌশিক মিশ্র
এগরা শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:০৫
Share: Save:

সময়টা ষাট-সত্তরের দশক। পুজোর মুখে নতুন বাংলা সিনেমা দেখতে লম্বা লাইন পড়েছিল শহরের নারায়ণ সিনেমা হলে। কিন্তু লাইনের তোড়ে সিনেমা দেখা দূর, টিকিটই মেলেনি দু’দিন ধরে। বাড়ির বারান্দায় বসে স্মৃতিচারণ করছিলেন বছর পঁচাশির শ্রীকান্তবাবু। এগরার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের এই বাসিন্দা স্মৃতিমেদুর গলায় তাই বলে ওঠেন, “অনেক দিন তো হল, সেই এগরা শহরও নেই, আর সিনেমা হলগুলো তো সব শিকেয় উঠেছে।”

এগরা শহরে একটা সময় বিনোদন বলতে শুধুই ছিল হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। শনি-রবিবার তো বটেই, এমনি দিনেও ভিড় লেগেই থাকত শহরের নারায়ণ আর রাজশ্রী সিনেমা হলে। ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি করা হত। এমনকী হল হাউস ফুল থাকায় হলের মেঝেতেও পর্দার সামনে বেঞ্চে বসে সিনেমা দেখেছেন অনেকে। মাঝে কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। ১৯৯৩ সালে এগরা শহর পুরসভার মর্যাদা পেয়েছে। আর এর মধ্যেই শহরের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম সিনেমা হলগুলি গিয়েছে বন্ধ হয়ে।

নারায়ণ সিনেমার ইতিহাস সম্পর্কে জানা গেল এগরার বিখ্যাত গিরি পরিবারের কাছ থেকে। ওই বাড়ির সদস্যরা জানান, হরনারায়ণ গিরির নামানুসারে ষাটের দশকে এগরার কলেজ রোডে পটাশপুরগামী রাস্তার পাশে শুরু হয় এগরার প্রথম সিনেমা হলটি। এই নারায়ণ সিনেমা হল দিয়েই শুরু হয়েছিল এগরায় সিনেমা-বিনোদনের। পরিকাঠামো আধুনিক না হলেও এগরার পাশ্ববর্তী এলাকায় সাড়া ফেলেছিল সিনেমা হলটি। তখন ডায়নামো চালিয়ে সিনেমা দেখানো হত। তাই লোকের মুখে মুখে এই হলে নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ডরডরিয়া ডায়নামো’। পারিবারিক ও অর্থনৈতিক কারণে ১৯৯০ সাল নাগাদ সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে ওই হল খোলায় উদ্যোগী হননি কেউই। আর সম্প্রতি ওই সিনেমা হলে মাথা তুলে উঠে দাঁড়িয়েছে দোকানঘর।

দ্বিতীয় সিনেমা হলটি ছিল এগরার দিঘামোড়ে রাজশ্রী সিনেমা হল। প্রথমে হলটি পরিচিত ছিল ‘বর্ণালী’ নামে। ১৯৭০ সালে ডক্টর পি মিশ্র, অসীম পাণিগ্রাহী, সামসুল আলম খান ও রবীন্দ্র মাইতি চার অংশীদার মিলে সিনেমা হলটি চালু করেন। রমরমিয়ে চলত হলটি। ১৯৮০ সাল নাগাদ রবীন্দ্র মাইতি ওরফে মানিকবাবু ও তাঁর ভাইরা মিলে হলের মালিকানা নিজেদের হাতে নেন। সেই সময় ‘বর্ণালী’ নাম বদলে হয়ে যায় ‘রাজশ্রী’। ১৯৯০ সাল নাগাদ মানিকবাবু অসুস্থ হয়ে পড়লে বাকি ভাইরা কিছুদিন ধরে লোকসানের মধ্যেও সিনেমা হলটি চালু রাখেন। কিন্তু ধীরে ধীরে কমতে থাকে দর্শক সংখ্যা। লোকসানের বহর বাড়তে থাকায় হলটি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

রাজশ্রী সিনেমাহলের মালিক মণীন্দ্র মাইতি ও সৌমেন্দ্র মাইতির কথায়, “আমরা উদ্যোগী হয়ে হলটি চালু রেখেছিলাম। কিন্তু দিনের পর দিন ফাঁকা হল নিয়ে ব্যবসা চালানো যায়?” তাঁদের থেকেই জানা যায়, ভিডিও-র মাধ্যমে সিনেমা দেখার কথা। বাড়িতে বাড়িতে টেলিভিশনের আবির্ভাব, সরকারি সাহায্যের অভাব ছাড়াও আরও অনেগুলি কারণে সিনেমা হলগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন দর্শকরা। ফলে লোকসানে চলা বিনোদন হলগুলি বন্ধ হতে থাকে। আধুনিকীকরণের অভাবও দর্শক টানতে না পারাও হল বন্ধ হওয়ার একটা কারণ বলে মানেন তাঁরা।

তা হলে এলাকার বাসিন্দারা এখন কোথায় সিনেমা দেখতে যান? কাজ সেরে বইয়ের পাতায় চোখ রেখে শহরে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বছর বিয়াল্লিশের গৃহবধূ অসীমা দাস বলেন, “মনে আছে, পরিজনরা এলে রাজশ্রী সিনেমা হলে কত যে সিনেমা দেখেছি। এখন আর কী আর করা যাবে? কেবল টিভি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাও বাঁচোয়া, স্থানীয় কেবল অপারেটর টিভিতে সিনেমাগুলো চালায়।” কিন্তু এলাকার স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারাও কি সেই টিভিতেই সন্তুষ্ট? কাঁধ ঝাঁকিয়ে এগরা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শিবু মাইতির জবাব, “না, না, তা কেন? বন্ধুরা মিলে আমরা যাই কাঁথিতে। সেখানে অনেক হল রয়েছে। যা দেখার ইচ্ছে হয়, দেখে নিই।” কিন্তু কাঁথি থেকে এগরা শহর তো প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। যেতে যেতেই তো সময় কাবার? বছর কুড়ির ওই ছাত্রের হাসিই বুঝিয়ে দেয়, এটা ছাড়া আর অন্য কোনও উপায়ও নেই তাদের। কিন্তু সমস্যা যে হয়, তা বলে ফেলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কিশোরী। তার কথায়, “যাতায়তে এত সময় লাগেই বলে বাড়ি থেকে কেউ ছাড়তে চান না। তবু বন্ধ-বান্ধবদের সঙ্গে প্রায়ই লুকিয়ে সিনেমা দেখতে যেতে হয়। কাছাকাছি সিনেমা হল থাকলে খুব ভাল হত।”

তাছাড়া এগরা শহরে বিনোদনের উপায় কিছুই নেই। এখানে নেই কোনও বিনোদন পার্ক, যেখানে কিছুটা সময় এখান্তে কাটানো যায়। এমনকী নাটক বা অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ করারও কোনও জায়গা নেই। এগরার প্রসিদ্ধ নাট্যদল কৃষ্টিচক্রের সম্পাদক শুভাশিস মাইতি বলেন, “আমাদের প্রতিবছর নাট্য-উৎসবের আয়োজন করতে হয় ফাঁকা মাঠে মণ্ডপ করে। এগরাতে সাংস্কৃতিক বিনোদনের কোনও ব্যবস্থা নেই।”

১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৪-সময়টা কম নয়। পুরসভা হওয়ার এত দিন পরও শহরের বাসিন্দাদের পুর-পরিষেবার দিকে নজর দেওয়া হয় নি কেন? সিপিএমের সুব্রত পণ্ডা বলেন, “প্রথম দিকে আমরা যখন দায়িত্ব পেয়েছিলাম, তখন পুরসভার প্রাথমিক অবস্থা ছিল। খুব বেশি পরিকাঠামো গড়া সহজ ছিল না।” সম্প্রতি মেয়াদ ফুরনো এগরা পুরবোর্ডের চেয়ারম্যান তৃণমূলের স্বপন নায়কের দাবি, “কয়েকটি পার্ক সংস্কারের চেষ্টা করেছি। কিন্তু সব করে ওঠা যায়নি।” কিন্তু তৃণমূল তো ক্ষমতায় ছিল ১৫ বছর। সেই সময়টাও নেহাত কম নয়! এত দিনে কী কাজ হল? স্বপনবাবুর উত্তর, “আমি মোটে পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিলাম। তার মধ্যে যতটা করার করেছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE