Advertisement
E-Paper

৭০ টাকাতেই ব্রাউন সুগার

মাঠ বা খোলা জায়গার হামেশাই চোখে পড়ে জটলা থেকে পাক খেয়ে উঠছে ধোঁয়া। বুঁদ হচ্ছে অল্পবয়সীরা। মেদিনীপুর-খড়্গপুর দুই শহরেরই। পুলিশের দাবি নজরদারি, ধরপাকড় চলে। সচেতনতা কর্মসূচিও হয়। আজ, ২৬ জুন বিশ্ব মাদক বিরোধী দিবস। তার আগে দুই শহরের নেশা-ছবি তুলে ধরলেন বরুণ দে ও দেবমাল্য বাগচীএক ঝলক দেখলে মনে হবে হোমিওপ্যাথি ওষুধের পুরিয়া। ৭০ টাকা দিলেই সেই পুরিয়া চলে আসবে হাতে। হোমিওপ্যাথি ওষুধ নয়, পুরিয়ার ভেতরে ব্রাউন সুগার। শুধু মদ, গাঁজা, হেরোইন, চরস কিংবা ব্রাউন সুপার নয়, বহু অপ্রচলিত বা স্বল্পপরিচিত মাদকও ঢুকে পড়ছে দুই শহর ও শহরতলিতে।

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬ ০৭:০৭

এক ঝলক দেখলে মনে হবে হোমিওপ্যাথি ওষুধের পুরিয়া। ৭০ টাকা দিলেই সেই পুরিয়া চলে আসবে হাতে। হোমিওপ্যাথি ওষুধ নয়, পুরিয়ার ভেতরে ব্রাউন সুগার।

শুধু মদ, গাঁজা, হেরোইন, চরস কিংবা ব্রাউন সুপার নয়, বহু অপ্রচলিত বা স্বল্পপরিচিত মাদকও ঢুকে পড়ছে দুই শহর ও শহরতলিতে। একাধিক মাদক বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে সেবনের প্রবণতা বাড়ছে অল্পবয়সীদের মধ্যে। এমনকী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে স্কুল পড়ুয়াদের একাংশ। শুধু সেবন নয়, মাদকের কারবারেও জড়াচ্ছে অল্পবয়সীরা। পুলিশেরই এক সূত্রে খবর, গত কয়েক মাসে মাদকদ্রব্য-সহ যাদের পাকড়াও করা হয়েছে, তাদের মধ্যে স্কুল পড়ুয়াও রয়েছে। মেদিনীপুরের এক নেশামুক্তি ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের অধিকর্তা নন্দিতা বসু জানালেন, আসক্তদের মধ্যে মেধাবীরাও যেমন রয়েছে, তেমন লেখাপড়া না জানা ছেলেও রয়েছে।

আজ, রবিবার মাদক বিরোধী দিবস। পশ্চিম মেদিনীপুরেও দিনটি পালন হবে। পুলিশের উদ্যোগে ঝাড়গ্রাম, খড়্গপুর, মেদিনীপুরে সচেতনতা প্রচার হবে। কিন্তু, প্রদীপের নীচেই যে অন্ধকার!

দুই শহরের মানুষেরই অভিযোগ, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার জন্য মাদক কারবারের এই রমরমা। সেই সঙ্গে মাদকাসক্ত লোকজনের দৌলতে শহরে দুষ্কর্মও বাড়ছে। নিষ্ক্রিয়তার কথা অবশ্য মানতে নারাজ পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘সারা বছরই রুটিন নজরদারি থাকে। নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। কোথাও কোনও খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।’’

পুলিশ সুপার যা-ই বলুন না কেন, সন্ধে নামলেই শহর-শহরতলির বিভিন্ন এলাকায় মাদকের কারবার শুরু হয়। দিনেদুপুরেও বিভিন্ন এলাকায় হাতবদল হয় মাদক-পুরিয়ার। খড়্গপুরে একসময়ে স্থায়ী দোকানে এই পুরিয়া পাওয়া গেলেও এখন ‘ফ্লাইং সেলিং’ সবচেয়ে বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, বহু ভাষাভাষির এই শহরে অপরিচিত মানুষের যাতায়াত লেগে থাকায় সেই সূত্র ধরেই জাল ছড়াচ্ছে মাদক কারবারিরা। শহরের পাঁচবেড়িয়া, ইন্দা বিদ্যাসাগরপুর, বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন গাঁধীনগর, বোগদা, পুরাতনবাজার, কৌশল্যা এলাকায় হেরোইন বা ব্রাউন সুগারের কারবার দীর্ঘদিনের। সন্ধের পরে শহরের অন্ধকারাচ্ছন্ন মাঠগুলিতে অবাধে চলে মাদক বেচাকেনা। ট্রাফিকের কল্যাণ মণ্ডপের পিছনের ময়দান, ইন্দা বয়েজ স্কুলের ময়দান, সাঁজোয়ালের একাধিক ছোট ময়দান, মালঞ্চ পোস্ট অফিসের পিছনের ময়দানে এই কারবার চলে রমরমিয়ে। রেলশহর থেকেই লাগোয়া মেদিনীপুর, বেলদা, ডেবরায় ছড়িয়ে পড়ে মাদকদ্রব্য।

শুধু মাদকের কারবার নয়, শহরে বাড়ছে মাদক পাচারকারীর সংখ্যাও। এমনকী মহিলারাও এই কারবারে যুক্ত হয়ে পড়ছে। মেদিনীপুরে এমন একাধিক মহিলা রয়েছে, যাদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় বিকোয় হেরোইন, গাঁজা, চরস। অনেকে লিঙ্কম্যান হিসেবে কাজ করে। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে খড়্গপুরের ইন্দা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল মিনু দেব ও তার বৌমা বর্ষা দেবকে। মেদিনীপুরের বাসিন্দা এই দুই মহিলার থেকে পাওয়া গিয়েছে ১২১ গ্রাম ব্রাউন সুগার। এক সময়ে এই কারবারে যুক্ত পাঁচবেড়িয়ার এক বাসিন্দার কথায়, “আধ গ্রামেরও কম ওজনের ব্রাউন সুপারের একটি পুরিয়ার দাম প্রায় ৬০ থেকে ৭০টাকা। আগে মূলত ছেলেরা এই কারবারে জড়িত থাকলেও ঝুঁকি এড়াতে এখন মহিলাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যত কড়াকড়ি হয় তত দাম বাড়ে, বাজার চাঙ্গা হয়।”

পুলিশ সূত্রে খবর, এ রাজ্যে হেরোইন সাধারণ ঢোকে বাংলাদেশ থেকে বঁনগা সীমান্ত হয়ে। অসম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড থেকে মূলত আসে গাঁজা। পরে তা একাধিক হাত ঘুরে জেলায় জেলায় পৌঁছয়। কারবারিদের ঠিকানা জানা থাকলে খুব সহজেই নেশার দুনিয়ায় ঢুকে পড়া যায়। জানা গিয়েছে, এখন ব্রাউন সুগার ছাড়াও শহরে কাশির সিরাপ, ব্যাথার ওষুধ, ডেন্ড্রাইটের নেশা বাড়ছে।নিয়ম বহির্ভূতভাবে লাগামছাড়া বিক্রি হচ্ছে এ সব জিনিস। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক অনিরুদ্ধ ঘোড়াই বলেন, “নিয়মিত এ ধরনের মাদক সেবনে কিডনি, ফুসফুস ও যকৃৎ বিকল হতে থাকে। ব্রাউন সুগার খেলে দু’বছর ও ব্যাথার ওষুধ খেতে থাকলে তিন-চার বছরেই মানুষের মৃত্যু হতে পারে।”

কিন্তু এই কারবারে রাশ টানা যাচ্ছে না কেন? শহরবাসীর অভিযোগ, পুলিশ অভিযান চালায় ঠিকই। তবে মাদক পাচারে মূল পান্ডাদের কেউ ধরা পড়ে না। যারা ধরা পড়ে তাদের বেশিরভাগই বাহক। আর তারা সহজে জামিনও পেয়ে যায়। কারণ, ‘নারকোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্সেস’(এনডিপিসি) আইন অনুযায়ী, ব্রাউন সুগারের ক্ষেত্রে ১০ গ্রামের বেশি ও গাঁজার ক্ষেত্রে ২১ কেজির বেশি পরিমাণ মাদক পাওয়া গেলে তবেই মামলা রুজু হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই পরিমাণ মাদক উদ্ধার না হওয়ায় জামিন পেয়ে যায় অভিযুক্তরা। খড়্গপুরের পাঁচবেড়িয়ার ব্যবসায়ী ভুট্টু খান বলেন, “আমাদের এলাকায় এই কারবার রমরমিয়ে চলছে। ২০১৩ সালে পুলিশ সক্রিয় হয়েছিল। আমি নিজে দু’টি এনডিপিসি মামলায় সাক্ষী হয়েছিলাম। কিন্তু এখন পুলিশ উদাসীন। খবর দিলেও ধরপাকড় করে না।”

এই পরিস্থিতিতে সচেতনতাই একমাত্র দাওয়াই। কিন্তু মাদক বিরোধী দিবসে সচেতনতা শিবিরের যে হিড়িক দেখা যায়, সারাবছর তার কণামাত্র থাকে না বলে অভিযোগ। খড়্গপুরের মহকুমাশাসক সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেন, “মাদকের কারবার বন্ধ করতে সকলের সমন্বয় প্রয়োজন। মানুষকে সচেতন হতে হবে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিকে আরও সক্রিয় হতে হবে।” ইন্দার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অধীনে চলা নেশা নিরাময় কেন্দ্রের সম্পাদক এস সঞ্জয় রাওয়ের অবশ্য বক্তব্য, “আমরা মাঝেমধ্যেই স্কুল-কলেজ থেকে পাড়ার ক্লাবগুলিতে গিয়ে মাদক বিরোধী সচেতনতা চালাই। আমাদের কেন্দ্রে বিনামূল্যে চিকিৎসাও হয়।’’ ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল ও রামপ্রসাদ সাউ।

brown sugar addiction
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy