গত ক’দিন ধরে রাস্তা, দোকান, অফিস— সব জায়গাতেই শুধু নোট-আলোচনা। তার রেশ এসে পড়েছিল ভোট প্রচারের মঞ্চেও। তমলুক লোকসভায় উপ-নির্বাচনের প্রচারে এসে তৃণণূল, সিপিএম, কংগ্রেস, সকলেই নিজ নিজ যুক্তি মোদী সরকারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। এটা ঠিক নন্দীগ্রামের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরে বিজেপি নেহাতই দুর্বল। তবু আজ, শনিবারের এই উপ-নির্বাচনে সব হিসেব ছাপিয়ে নোট প্রসঙ্গ এসে পড়বে বলেই রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
নোট নিয়ে এখন সরগরম দিল্লির রাজনীতি। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাজধানীর পথে নেমেছেন। তৃণমূল নেত্রীর এই কড়া অবস্থান তমলুক কেন্দ্রের ভোটাররা কী চোখে দেখছেন, উপ-নির্বাচনে তার একটা আভাস মিলবে বলেই আশা। সেই সঙ্গে দেখা যাবে কত শতাংশ মানুষ বিজেপি সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সত্যিই সমর্থন করল। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে জেলায় তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫১.৯৭ শতাংশ। বামেদের ৩৫.০৫ শতাংশ, কংগ্রেসের ২.৩২ শতাংশ, বিজেপি-র ৭.৯২ শতাংশ। গত বিধানসভা ভোটে জেলায় তৃণমূলের ভোট প্রাপ্তির হার ৫০.২৭ শতাংশ। বাম–কংগ্রেসের মিলিত ভাবে পেয়েছে ৪০.৩৪ শতাংশ ভোট। আর বিজেপি-র ভোট প্রাপ্তির হার ৬. ১৪ শতাংশ। এ বার ভোটে বিজেপির ভোট বাড়ে কি না, সেটাই দেখার।
২০০৮ থেকে পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূলের একাধিপত্য। তবে মাত্র ছ’মাস আগে তিনটি বিধানসভা আসন খুইয়েছিল তারা। যে তিনটি আসনে বাম প্রার্থীরা জিতেছিলেন, তার সব ক’টিই আবার তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। ফলে, তমলুক লোকসভায় উপ-নির্বাচন দু’পক্ষের কাছেই পাখির চোখ। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে পূর্ব মেদিনীপুরে নিরঙ্কুশ ছিল তৃণমূল। ১৬টি আসনের সব ক’টিই গিয়েছিল ঘাসফুলের ঝুলিতে। কিন্তু গত বিধানসভা ভোটে সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩য়। তমলুকের সাংসদ পদ ছেড়ে নন্দীগ্রাম বিধানসভা থেকে লক্ষাধিক ভোটে জিতে মন্ত্রী হয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু তাঁর খাসতালুক হলদিয়ায় বামেদের আঁচড় রুখতে পারেননি। শিল্পশহরে ২১ হাজারের বেশি ভোটে হার হয়েছে শাসকের। তুলনায় কম ব্যবধানে খোয়াতে হয়েছে তমলুক বিধানসভা (৫২০ ভোট)। আর পূর্ব পাঁশকুড়া বিধানসভা কেন্দ্রে বাম প্রার্থী জিতেছেন ৪,৭৬৭ ভোটে।
এ বার উপ-নির্বাচনে অধিকারী বাড়ির আর এক ছেলে দিব্যেন্দু অধিকারীই তৃণমূল প্রার্থী। তাই ভাইকে জিতিয়ে বিধানসভার ক্ষত মেরামতে গোড়া থেকেই ঝাঁপিয়েছেন শুভেন্দু। জয়ের ব্যবধান নিয়ে আগাম লক্ষ্যমাত্রা পর্যন্ত বেঁধে দিয়েছে শাসকদল। ২০১৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তমলুক কেন্দ্রে শুভেন্দু জিতেছিলেন ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ভোটে। উপ-নির্বাচনে দিব্যেন্দুর জয়ের ব্যবধান বাড়িয়ে তিন লক্ষে নিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। আর সেখানে বড় ভরসা নন্দীগ্রাম। এই বিধানসভা থেকে এক লক্ষেরও বেশি ‘লিড’ চাওয়া হয়েছে। আর হলদিয়া, তমলুক ও পূর্ব পাঁশকুড়াতেও বড় ‘লিড’ নেওয়ার লক্ষ্যে রয়েছে তৃণমূল।
ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগে প্রস্তুতি। কোলাঘাটে। —পার্থপ্রতিম দাস।
গত বিধানসভা ভোটে পূর্ব মেদিনীপুরে তুলনামূলক খারাপ ফলের ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতাদের গোষ্ঠী কোন্দল যে অন্যতম কারণ তা টের পেয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তাই তমলুকে উপ-নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার আগে থেকেই হলদিয়া, তমলুক ও পূর্ব পাঁশকুড়া এলাকায় স্থানীয় নেতাদের এক ছাতার তলায় এনে আলোচনায় বসেছিলেন নেতৃত্ব। সেই সঙ্গে সমানে চলেছে বিরোধী ভাঙানোর খেলা।
তবে উপ-নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের সমঝোতা না হওয়ার ফসলও তৃণমূল ঘরে তুলবে বলে রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের ধারণা। সব হিসেব মাথায় রেখে জেলা তৃণমূল সভাপতি শিশির অধিকারী তাই ভোটের আগে বলছেন, ‘‘গত বিধানসভায় হাতছাড়া তিন আসনেই দলের সাংগঠনিক শক্তিক্ষয় মেরামত করা হয়েছে । ২০১৪-র লোকসভা ভোটের থেকেও বেশি উপ-নির্বাচনে জিতব আমরা।’’
যা পরিস্থিতি তাতে হলদিয়া, তমলুক ও পূর্ব পাঁশকুড়া বিধানসভা আসনে জয় ধরে রাখটা বামেদের কাছে চ্যালেঞ্জ। উপ-নির্বাচনের মুখেই দলের বহু সক্রিয় কর্মী তৃণমূলে গিয়ে যোগ দিয়েছেন। সংশয় রয়েছে প্রতি বুথে পোলিং এজেন্ট দেওয়া নিয়েও। তার উপর চিন্তা বাড়িয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে বিচ্ছেদ। প্রতি বুথে পোলিং এজেন্ট দিতে পারছে না কংগ্রেসও। এই অবস্থায় নির্বাচনী প্রচারে বিরোধী বাম, কংগ্রেস, বিজেপি— সকলেই অধিকারীদের পরিবারতন্ত্র এবং শাসকের সন্ত্রাস নিয়ে সরব হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের সিপিএমের জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি শুক্রবারও বলেন, ‘‘সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকায় মানুষ অবাধে বুথে গিয়ে ভোট দিতে পারবেন না কিনা আশঙ্কা থাকছে। তবে স্বাভাবিকভাবে ভোট হলে বিধানসভার চেয়ে ভাল ফল হবে।’’ একই সুর বিজেপি-র জেলা সভাপতি মলয় সিংহ ও জেলা কংগ্রেস সভাপতি আনোয়ার আলির গলায়।