হলদিয়া-মেচেদা রাজ্য সড়কে হেলমেট ছাড়াই বাইকে সওয়ার। পার্থপ্রতিম দাসের তোলা ছবি।
সাঁ সাঁ গতিতে ছুটছে বাইক। কোনওটিতে আরোহীর সংখ্যা দুই, কোনওটিতে আবার তিন জন। কারও মাথাতেই হেলমেট নেই!
জুলাই মাসে বার্তা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যকে দুর্ঘটনামুক্ত করতে ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই শুরু হয়েছিল ধরপাকড়। হেলমেটবিহীন মোটর বাইক আরোহী ধরতে চলছিল অভিযান। পেট্রোল পাম্প বন্ধ করে দিয়েছিল তেল দেওয়া।
পূর্ব মেদিনীপুরের সদর শহর তমলুক ও মেচেদা, কোলাঘাট, নন্দকুমার, চণ্ডীপুর থানার বিভিন্ন সড়কে পুলিশের নজরদারিতে ধরা পড়েছিলেন অনেকেই। রেহাই পেতে হিড়িক পড়ে গিয়েছিল হেলমেট কেনার। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত দেড়় মাসে হেলমেটের বিক্রি বেড়েছিল প্রায় ৬-১০ গুণ। রাস্তাঘাটেও হেলমেট ছাড়া মোটর বাইক আরোহীর সংখ্যা অনেকটাই কমে যায়।
কিন্তু মাস দুই ঘুরতে না-ঘুরতেই ছবিটা বদলাতে শুরু করেছে। রাস্তায় ফের দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন হেলমেট বিহীন মোটর বাইক চালকরা। পুলিশকে দেখাতে অনেকে আবার কনুইয়ে গলিয়ে রাখছেন হেলমেট, কেউ বা বাইকের পিছনের ঝুলিয়ে দিচ্ছেন নতুন কেনা হেলমেট। এদের মধ্যে নব্য যুবকদের সংখ্যাই বেশি। জিজ্ঞাসা করলে হাসি মুখে এক সদ্য আঠারোর যুবক জবাব দিলেন, ‘‘বড্ড গরম লাগে।’’ কোলাঘাটের বাসিন্দা বছর চল্লিশের প্রেমানন্দ দোলই আবার বলেন, ‘‘হেলমেট পরলে মাথার চুল উঠে যায়। তাই পরি না।’’
সাধারণ মানুষের অভিযোগ, পুলিশি নজরদারিতেও সামান্য তেমন জোর নেই এখন আর। এখন আর সারাদিনের অভিযান চলছে না। কোথাও শুধু সকালে, আবার কোথাও শুধু বিকেলে পুলিশের তল্লাশি চলছে নাম-কা-ওয়াস্তে। যদিও জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া অবশ্য বলেন, ‘‘হেলমেটহীন মোটর বাইক চালকদের ধরার অভিযান কমেনি। গত দু’মাসের অভিজ্ঞতায়আমরা দেখেছি সকালের চেয়ে সন্ধ্যা বা রাতের দিকেই হেলমেট না-পরে মোটর বাইক চালানোর প্রবণতা রয়েছে। তাই সন্ধ্যার পর থেকে অভিযান জোরদার করা হচ্ছে।’’
তমলুক থানার এক পুলিশ আধিকারিক জানান, ‘‘বহুবার নেতাদের ফোন এসেছে, কোনও না-কোন হেলমেটহীন বাইক আরোহীকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা ছাড়িনি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ কোনও ভাবেই অমান্য করা যাবে না। তাই সুপারিশের তোয়াক্কা না করেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’
কিন্তু তমলুক শহরের রাস্তায় ফের আগের মতই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে উঠতি বয়সের বাইক-বাহিনী, অধিকাংশই হেলমেটহীন। শহরের পার্বতীপুর এলাকার বাসিন্দা প্রদীপ্ত খাটুয়া বলেন, ‘‘প্রতিদিন বেশ কিছু যুবক প্রবল গতিতে মোটর বাইক ছুটিয়ে যাতায়াত করে। আমরা আতঙ্কিত। মাঝে কিছুদিন পুলিশি তৎপরতায় সেই দাপট বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু আবার যেই কে সেই।’’
স্থানীয় সূত্রে খবর, তমলুক শহরের মানিকতলা মোড়, হলদিয়া-মেচেদা রাজ্য সড়ক ও তমলুক-পাঁশকুড়া সড়কের সংযোগস্থলে নিয়মিত তল্লাশি চালায় পুলিশ। কিন্তু জেলা হাসপাতাল মোড়ের নজরদারিতে ঢিলেমি রয়েছে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ পড়েছে। ফলে ব্যস্ত রাস্তায় বাড়ছে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা। আর তমলুক শহর ছাড়িয়ে মেচেদা, কোলাঘাট, পাঁশকুড়া, নন্দকুমার থানা এলাকার রাস্তাগুলিতে পুলিশের তল্লাশি চলে কয়েক ঘণ্টার।
মাস ঘুরতে না ঘুরতে ফের পুলিশি অভিযানে ঢিলেমির জেরে মেদিনীপুরে ফিরেছে বাইক দৌরাত্ম্যের পুরনো ছবি।
শুধু রাস্তায় নয়, অনিয়মের ছবি পেট্রোল পাম্পগুলিতেও। শহরের পাম্পগুলি ‘নো হেলমেট, নো পেট্রোল’ নিয়ম সব সময় মানছে না বলে অভিযোগ। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে বাইক চালকের মাথায় হেলমেট না থাকলেও পেট্রোল মিলছে অনায়াসে।
পুলিশ অবশ্য অভিযানে ঢিলেমির কথা মানতে নারাজ। পুলিশের বক্তব্য, মেদিনীপুরের মতো শহরে নজরদারি চলেই। শহরের এক-এক জায়গায় এক-একদিন নজরদারি চালানো হয়। বিনা হেলমেটের বাইক চালকদের সতর্ক করা হয়। জরিমানাও আদায় করা হয়। জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ বলেন, ‘‘মেদিনীপুরে নজরদারি চলছে। হেলমেট ব্যবহার নিয়ে মানুষকে সচেতনও করা হচ্ছে। প্রয়োজনে শহরে নজরদারি আরও বাড়ানো হবে।”
মেদিনীপুরের বটতলাচকের একটি পেট্রোল পাম্পে হেলমেট না পরলেও মিলছে তেল। সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি।
গত জুলাইয়ে জেলায় ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ এবং সেই সূত্রে ‘নো হেলমেট, নো পেট্রোল’ কর্মসূচি চালু হয়। প্রশাসন জানিয়ে দেয়, হেলমেট ছাড়া পেট্রোল মিলবে না। হেলমেটহীন বাইক চালককে পেট্রোল দিলে পাম্পকে জরিমানা করা হবে। এই নিয়ম কার্যকরে জুলাই-অগস্টে পুলিশ যে ভাবে জোরকদমে অভিযানে নেমেছিল, সেপ্টেম্বরে তা কিন্তু অনেকটাই শিথিল। এমনিতেই জেলার সদর শহরে নানা কাজে প্রতিদিন বহু মানুষ আসেন। এখন পুজোর কেনাকাটা করতেও অনেকে আসছেন। বাইক দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ এঁদের অনেকেই। অয়ন পাল, সুস্মিতা দাস মালের মতো অনেকেরই মত, “পুলিশকে আরও কড়া হতে হবে। শুধু দু’-তিন দিন অভিযানে নেমে দায় সারলে হবে না। নিয়মিত নজরদারি চালাতে হবে। তবেই বেপরোয়া বাইক চলাচল বন্ধ হতে পারে।’’
অভিযানে ঢিলেমির প্রমাণ মিলেছে হেলমেট ব্যবহারের তথ্যেও। জানা গিয়েছে, গত জুলাইতে পুলিশি অভিযান শুরুর পর এক ধাক্কায় হেলমেট বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল। অগস্টে শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ বাইক আরোহী হেলমেট ব্যবহার করতেন। সেপ্টেম্বরে তা নেমে এসেছে ৫০ শতাংশে।
কিন্তু অভিযানে ঢিলেমির কারণটা কী? জেলা পুলিশের এক কর্তার সাফাই, ‘‘নজরদারি প্রতিদিনই চলে। তবে শহরের সব জায়গায় সব দিন হয়তো নজরদারি চালানো সম্ভব হয় না।” তাঁর আরও সংযোজন, প্রয়োজনের তুলনায় ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা কম। ফলে, অনেক সময়ই বিধি ভেঙে যাঁরা মোটরবাইক চালায়, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনত পদক্ষেপ করা যায় না। দ্রুত গতিতে মোটরবাইক চালানোর ফলে মাঝেমধ্যে বিপত্তিও ঘটছে। দিন কয়েক আগে মেদিনীপুরের এলআইসি মোড়ে দু’টি বাইকের ঠোকাঠুকি লাগে। একটি বাইকের চালক পড়ে যান। তবে তাঁর মাথায় হেলমেট থাকায় বড় কিছু হয়নি।
সমস্যা সমাধানে মেদিনীপুরে নজরদারি বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন পুলিশ সুপার। সেই মতো কাজ হয় কি না, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy