Advertisement
০৮ মে ২০২৪
নিমপুরা শিল্পতালুক

বকেয়ার বোঝা, ঝাঁপ বন্ধ কারখানার

রেলশহরে ঝাঁপ বন্ধ হল রেলেরই সরঞ্জাম তৈরির এক কারখানার। স্লিপার কোচের বার্থ তৈরির কাজে যুক্ত ‘এমিকো লিমিটেড’ নামে খড়্গপুরের নিমপুরা শিল্প তালুকের ওই কারখানায় গত সেপ্টেম্বরেই ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’-এর নোটিস ঝোলানো হয়েছিল। বৃহস্পতিবার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল কারখানাটি। এর ফলে ৩৯ জন স্থায়ী কর্মী কাজ হারালেন। দু’শোরও বেশি ঠিকাকর্মী আগেই কাজ হারিয়েছিলেন।

বন্ধ কারখানা চত্বর। গেটে ঝুলছে তালা (ইনসেটে)। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ

বন্ধ কারখানা চত্বর। গেটে ঝুলছে তালা (ইনসেটে)। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ

নিজস্ব সংবাদদাতা
খড়্গপুর শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৫ ০২:২৫
Share: Save:

রেলশহরে ঝাঁপ বন্ধ হল রেলেরই সরঞ্জাম তৈরির এক কারখানার। স্লিপার কোচের বার্থ তৈরির কাজে যুক্ত ‘এমিকো লিমিটেড’ নামে খড়্গপুরের নিমপুরা শিল্প তালুকের ওই কারখানায় গত সেপ্টেম্বরেই ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’-এর নোটিস ঝোলানো হয়েছিল। বৃহস্পতিবার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল কারখানাটি। এর ফলে ৩৯ জন স্থায়ী কর্মী কাজ হারালেন। দু’শোরও বেশি ঠিকাকর্মী আগেই কাজ হারিয়েছিলেন।
২০০৯ সালে ট্রেনের কামরায় ‘সাইড মিডিল বার্থ’ তুলে দেওয়ার ঘোষণা করে রেলমন্ত্রক। অথচ খড়্গপুরের এই শিল্পসংস্থাটি ওই বার্থ তৈরিরই বরাত পেয়েছিল। ফলে, তাদের প্রাপ্য ১৯ কোটি টাকা বকেয়াই থেকে যায়। এরপর ছোটোখাট ইঞ্জিনিয়ারিং সরঞ্জাম তৈরি করে কোনওমতে কারখানা চালু রেখেছিলেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কর্মীদের বেতন দিতে ঋণ নিতে হয় সংস্থাকে। ক্রমে বাড়তে থাকে ক্ষতির বহর। কারখানার ম্যানেজিং ডিরেক্টর লীলাধর অগ্রবাল বলেন, ‘‘আমি বকেয়া টাকা পাওয়ার জন্য অনেক লড়াই করেছিলাম। মামলা হয়েছিল। আদালতের রায়ও আমাদের পক্ষে ছিল। কিন্তু ‘ভারত আর্থ মুভার লিমিটেড’ (বিইএমএল) নামে যে সংস্থা আমাদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল তারা টাকা দেয়নি। জানিয়েছে, রেলের কাছ থেকে তারা টাকা পায়নি। এই অবস্থায় কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হলাম।’’

১৯৭৫ সাল থেকে কলকাতায় ছোট ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবসা করত এমিকো। ২০০৪ সালে খড়্গপুরের নিমপুরায় ইঞ্জিনিয়ারিং কারাখানা তৈরি করে তারা। গোড়ায় সংস্থাটি ছোট-বড় বিভিন্ন গাড়ির আসন তৈরি করত। ২০০৭ সালে তদানীন্তন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব দূরপাল্লার ট্রেনে সাধারণ ও বাতানুকুল কামরার ‘থ্রি-টিয়ারে’র পাশে তৃতীয় বার্থ তৈরি হবে বলে ঘোষণা করেন। ওই সাইড মিডল বার্থ নির্মাণের জন্য বিইএমএল-এর সঙ্গে চুক্তি হয় এমিকো-র। উৎপাদনের কাজও শুরু হয়। তখন কারখানায় স্থায়ী ৩৯ জন কর্মী ছাড়াও প্রায় দু’শো জন ঠিকাশ্রমিক কাজ করতেন। ২০০৯ সালে রেলমন্ত্রক ট্রেনের ওই বার্থ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে, লোকসানে পড়ে খড়্গপুরের কারখানাটি। প্রায় ১৯ কোটি টাকা বকেয়া থাকায় বিইএমএল-এর বিরুদ্ধে আদালতে যান কর্তৃপক্ষ। তবে তাতেও সুরাহা হয়নি। আদালত টাকা মিটিয়ে দিতে বললেও বিইএমএল জানিয়ে দেয়, রেল টাকা না দেওয়ায় তারা বকেয়া টাকা দিতে পারবে না। এই অবস্থায় বিল মেটাতে না পারায় গত বছর কারখানায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। গত সেপ্টেম্বরে কারখানার গেটে ঝোলানো হয় ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’-এর নোটিস।

এর পরই কারখানায় অধিকাংশ ঠিকাশ্রমিক অন্যত্র চলে যান। তবে স্থায়ী শ্রমিকেরা আশা রেখেছিলেন। তবে এ দিন কারখানা পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হওয়ায় তাঁরাও কাজ হারালেন। সাদাতপুরের বাসিন্দা কারখানার অপারেটর পদে কর্মরত অলোক মল্লিক বলেন, ‘‘সেপ্টেম্বরে সাসপেনশনের নোটিস দেওয়ার পরে ভেবেছিলাম রেলের থেকে বকেয়া পেয়ে গেলে আবার কারখানা ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রাপ্য বুঝে নিতে বলেছে। কারখানা বন্ধেরও বিজ্ঞপ্তি পড়েছে। সংসারে আমি একাই রোজগেরে। জানি না কী ভাবে মা-বোনের কাছে মুখ দেখাব।’’

এই ঘটনায় তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র দিকেই আঙুল তুলেছে বিরোধী শ্রমিক সংগঠনগুলি। কারখানার বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনের সম্পাদক শেখ ফিরোজ বলেন, ‘‘আগে এখানে সিটু ও আইটাক ছিল। তখন কারখানা ভালই চলছিল। পরে আইএনটিটিইউসি এসে অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগে চাপ দেয়। শুধু বকেয়ার বোঝা নয়, এই কারণেও লোকসান বেড়েছে।’’

রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতি আদৌ আশাপ্রদ নয়। একাধিক শিল্প সম্মেলনের আয়োজন করেও রাজ্য সরকার উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ আনতে পারেনি। অন্য দিকে, একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে। খড়্গপুর শিল্পতালুকেও বন্ধ হয়েছে একাধিক কারখানা। ২০১৩ সালে স্পঞ্জ আয়য়ন কারখানা ‘রামস্বরূপ’, ২০১৪ সালের শেষে পাইপ কারাখানা কালামাটি, ১১ মাস আগে শিশুখাদ্যের কারখানা বাসকিনাথ, বছর দু’য়েক আগে চৌরঙ্গীর এডি অয়েল মিল বন্ধ হয়ে যায়। আইটাকের জেলা সম্পাদক বিপ্লব ভট্টের মতে, ‘‘খড়্গপুরে ইতিমধ্যে ১০-১২টি কারাখানা বন্ধ হয়েছে। আরও ৫-৬টি কারখানা বন্ধের মুখে। রাজ্য সরকারের উদাসীনতায়
এই পরিস্থিতি।’’

যদিও আইএনটিটিইউসি-র পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি দীনেন রায়ের বক্তব্য, ‘আমাদের সরকার শিল্পের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু বাম আমলে অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিক ভাবে যে সব কারখানা তৈরি হয়েছিল, তারা আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। তবে এই কারখানা বন্ধের বিষয়ে রেলের নজর দেওয়া উচিত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kharagpur factory Nimpura BML INTTUC CITU
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE