Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

প্রচার নেই, আজও অজানা ইতিহাস

অবহেলায় ধুলো জমছে প্রাচীন স্থাপত্যে। কেশিয়াড়ির বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একাধিক মন্দির ও স্থাপত্য। প্রাচীন ওড়িশি ঘরানায় নির্মিত এই সকল নিদর্শন প্রমাণ করে, এক সময়ে এই অঞ্চল ওড়িশার অন্তর্গত ছিল। এই সকল প্রাচীন নিদর্শনগুলিকে নিয়ে ‘সার্কিট ট্যুরিজম’ গড়ে তোলার দাবিও দীর্ঘদিনের। তবে প্রাশসনিক উদ্যোগের অভাবে কেশিয়াড়ির ইথিহাস অজানাই রয়ে গিয়েছে অধিকাংশ পর্যটকের।

পর্যটন প্রসারে পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি কুরুমবেরায়।

পর্যটন প্রসারে পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি কুরুমবেরায়।

দেবমাল্য বাগচী
কেশিয়াড়ি শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৫ ০০:৩৮
Share: Save:

অবহেলায় ধুলো জমছে প্রাচীন স্থাপত্যে। কেশিয়াড়ির বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একাধিক মন্দির ও স্থাপত্য। প্রাচীন ওড়িশি ঘরানায় নির্মিত এই সকল নিদর্শন প্রমাণ করে, এক সময়ে এই অঞ্চল ওড়িশার অন্তর্গত ছিল। এই সকল প্রাচীন নিদর্শনগুলিকে নিয়ে ‘সার্কিট ট্যুরিজম’ গড়ে তোলার দাবিও দীর্ঘদিনের। তবে প্রাশসনিক উদ্যোগের অভাবে কেশিয়াড়ির ইথিহাস অজানাই রয়ে গিয়েছে অধিকাংশ পর্যটকের।

কথায় আছে, বাঙালির পায়ের তলায় সরষে। একটু ফুরসৎ পেলেই বেরিয়ে পড়া। কলকাতা থেকে কেশিয়াড়ির দূরত্বও খুব বেশি নয়। প্রচারের অভাবে অনেকে জানতেই পারেন না কেশিয়াড়ির প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা। এই এলাকাতেই রয়েছে কুরুমবেরা দুর্গ, সর্বমঙ্গলা মন্দির, ভসরাঘাটের সুবর্ণরেখা নদী চর, জগন্নাথ মন্দির। শোনা যায়, সপ্তদশ শতকের গোড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ভবানীপুরের প্রসিদ্ধ সর্বমঙ্গলা মন্দির। ওড়িশা রীতিতে মাকড়া পাথরে নির্মিত পূর্বমূখি এই মন্দিরের তিনটি চূড়া। মন্দিরের প্রবেশে বারোদুয়ারি, নাট মন্দির পেরিয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে পৌঁছতে হয়। দেবী এখানে দ্বিভূজা। কথিত আছে, বহু বছর আগে ভবানীপুরে একটি বইচ কুলের গাছ ছিল। শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময়ে এক বেনেঘরের বৌ পালকিতে আসার সময় পালকি থামিয়ে ওই গাছতলায় গিয়েছিলেন। এর পর সেখানে বসেই তিনি পাথর হয়ে যান। সেই থেকেই ওই এলাকায় পাথরকে সর্বমঙ্গলা দেবী রূপে পুজো শুরু হয়। মন্দিরে জগমোহন মূর্তি ও জয়া, বিজয়ার পিতলের মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়।

মন্দিরের দু’টি স্থানে ওড়িয়া লিপিও লক্ষ্য করা যায়। মন্দিরের বাইরের অংশের লিপি দেখে ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থে যোগেশচন্দ্র বসুর লেখা থেকে জানা যায়, মহারাজ মান সিংহের রাজত্বকালে শাহ সুলতান নামে এক ব্যক্তি কেশিয়াড়ি রাজস্ব কেন্দ্রের শাসনকর্তা ছিলেন। সেই সময়ে সুন্দর দাস নামে তাঁর এক কর্মচারী ও অর্জুন মহাপাত্র নামে এক দেওয়ানের তত্ত্বাবধানে রাজমিস্ত্রি বনমালি দাস ১৬১০ সালে এই মন্দির নির্মাণ করেন।

তবে সর্বমঙ্গলা মন্দিরকে ঘিরে পর্যটন বিস্তারের উপযোগী পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। সম্প্রতি ব্লক প্রশাসন মন্দিরে যাওয়ার জন্য ঢালাই রাস্তা তৈরি করেছে। তবে মন্দিরে যাওয়ার রাস্তায় পথ বাতির অভাব রয়েছে। আলো নেই মন্দির চত্বরেও। মন্দিরে পর্যাপ্ত সংখ্যায় শৌচালয় নেই। মন্দিরের সেবায়েত কমিটির সম্পাদক আশিস মিশ্র বলেন, “প্রতিদিন মন্দিরে ভিড় তো থাকেই। তবে শৌচালয়ের অভাব থাকায় মন্দিরে বেশি ভিড় বাড়লে সমস্যা বাড়ে। এ ছাড়া রাতে মন্দির চত্বরে আলোরও অভাব রয়েছে। প্রশাসনিক এই কাজগুলো করলে ভাল হয়। একটি ট্রাস্টি বোর্ডের জন্যও আমরা আদালতে আবেদন জানিয়েছি।”

এই মন্দিরের পূর্ব দিকে রয়েছে কাশীশ্বর শিবের মন্দির। অনেকের মতেই এই মন্দিরের নাম থেকেই কেশিয়াড়ি নামের উৎপত্তি। সর্বমঙ্গলা মন্দির গড়ে ওঠার সময়েই এই মন্দিরও গড়ে তোলা হয় বলে স্থানীয়রা মনে করেন। সংস্কারের অভাবে এই মন্দিরের অবস্থাও জীর্ণ। তল কেশিয়াড়ি এলাকায় জগন্নাথের পঞ্চরথ মন্দির নির্মাণেও ওড়িশা ঘরানার ছাপ স্পষ্ট। মন্দিরের বাইরের দেওয়াল ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছে রথের অংশ। তবে এখনও মন্দিরের সামনের রাস্তা পাকা হয়নি।

পর্যাপ্ত পথবাতি ও শৌচালয়ের অভাব রয়েছে সর্বমঙ্গলা মন্দির চত্বরেও।

প্রচারের অভাবে কেশিয়াড়ির ঐতিহ্যময় কুরুমবেড়া দুর্গের কথাও অনেকের অজানা। কেশিয়াড়ি থেকে কুকাই হয়ে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে গগনেশ্বর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় অবস্থিত এই দুর্গ আনুমানিক পঞ্চদশ শতকে ওড়িশার রাজা কপিলেশ্বর দেবের আমলে গড়ে ওঠে। কথিত আছে, পাঠান আমলে দাউদ খাঁ মোগলদের কর দেওয়া বন্ধ করে নিজেকে স্বাধীন নবাব বলে ঘোষণা করেন। সেই সময় মোগলরা যুদ্ধ ঘোষণা করলে দাউদ খাঁ এই দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই সময় দাঁতনের মোগলমারির কাছে সেনা ছাউনি থেকে মোগল সৈন্যরা এই দুর্গ ঘিরে ফেলে। মৃত্যু হয় দাউদ খাঁর। ওই এলাকা থেকে ঔরঙ্গজেবের সময়কার মুদ্রারও সন্ধান মিলেছে। পরে এই দুর্গে মারাঠারাও ঘাঁটি তৈরি করেছিল বলে মনে করা হয়। নৃতত্ত্ববিদ প্রবোধচন্দ্র ভৌমিক তাঁর ‘মেদিনীপুর কাহিনী’তে জানিয়েছেন, ‘ওই দুর্গের কাছে গেলে কত কথাই না মনে পড়ে- হিন্দু, মোগল, পাঠান, মারাঠা কত সৈন্য এখানে দিন কাটিয়েছে তার আর হিসাব নেই’।

কুরুমবেরা দুর্গ ঘিরে পর্যটকদের জন্য আলাদা পরিকাঠামো গডে় ওঠেনি। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এক জন স্থায়ী ও এক জন অস্থায়ী কর্মী রয়েছেন। খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে দুর্গের মধ্যে থাকা টিউবওয়েল। নেই পর্যটকদের বোঝানোর জন্য কোনও গাইডও। কলকাতা থেকে কুরুমবেরা ঘুরতে গিয়েছিলেন সঞ্চয়িতা রায়। তাঁর কথায়, ‘‘এক রাত এখানে থাকব বলে এসেছিলাম। তবে এখানে থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই। অগত্যা রাতের সৌন্দর্য না দেখেই ফিরে যেতে হল।’’

শীতে বনভোজন হোক বা নৌকা বিহার, ভসরাঘাটের মতো সুবর্ণরেখার তীরবর্তী পিকনিক স্পটের জুড়ি মেলা ভার। এ ছাড়াও কেশিয়াড়ি শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে তৈরি হয়েছে পার্ক। কুসুমপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে কিয়ারচাঁদেরও সন্ধান মিলেছে। জনশ্রুতি, সাঁকরাইলে ওই এলাকায় নিজের এক সময় গড়ের পাহারা দিতে পাথর দিতে নকল সৈন্যের অবয়ব তৈরি করেছিলেন। রাত হলেই সেই পাথরের সৈন্য মূর্তিগুলিতে মশাল জ্বালিয়ে দিতেন। এতেই জঙ্গলের দস্যুরা ভয় পেতেন বলে বিশ্বাস করা হত। কিন্তু সেই পাথরের সৈন্যের মূর্তিগুলি এখন অবহেলায় ক্ষয়ে গিয়েছে।

শহরের মধ্যেও স্বল্প দূরত্বে যেতে কোনও অটো বা রিকশা পরিষেবা না থাকায় ভরসা গাড়ি বা মোটরবাইক। কিন্তু তার পরেও কিছু হয়নি। ব্লকের বিডিও অসীমকুমার নিয়োগী বলেন, “এই প্রাচীন নিদর্শনগুলির যথেষ্ট ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ওই সব এলাকার উন্নয়নে কংক্রিটের রাস্তা তৈরি হচ্ছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘কুরুমবেরায় প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় রাস্তা তৈরির কথা রয়েছে। কয়েকটি দর্শনীয় স্থান নিয়ে কেশিয়াড়িতে সার্কিট ট্যুরিজম করার প্রস্তাব শীঘ্রই জেলা পরিকল্পনা কমিটিকে জানাব।”

ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE