নিজের নামে একটা জমি কিনতে চান, চাঁদে বা মঙ্গলে! কিনে ফেলতে পারেন খুব সহজে। আবার মেদিনীপুরে জমি কেনার টাকা দিয়ে বিপদে প়ড়াটাও বেশ সহজ।
এই যেমন দিন কয়েক আগে সদর শহরের পদ্মাবতী শ্মশান লাগোয়া বেশ কয়েক বিঘা জমি বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল। পুরসভার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেননি মালিক। খুশিমতো মাস্টার প্ল্যানও বের করে নেওয়া হয়েছিল। ঘটনাটা পুরসভা জানতে পারল যখন জমি বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে সৌভাগ্য নড়ে বসেছে পুর-কর্তৃপক্ষ। শ্মশান সংলগ্ন ওই জমি যাতে রেজিস্ট্রি করা না-হয়, সে জন্য পুরসভা চিঠি পাঠিয়েছে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরকে। আপাতত বন্ধ জমি বেচার কাজ। কিন্তু এই সমস্যা তো শুধু একটি ঘটনায় নয়। জমির দালাল চক্রে জেরবার মেদিনীপুর। বিপদে পড়ছেন সাধারণ ক্রেতারা। তেমনই পুরসভাও পড়ছে সমস্যায়।
নিয়ম অনুযায়ী, একটি দাগে ২৫ ডেসিমেলের বেশি জমি থাকলে তা মাস্টার প্ল্যান করে বিক্রি করতে হয়। সেই প্ল্যান সঠিক কিনা তা নির্ধারণ করে পুরসভা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এক শ্রেণির দালাল চক্র পুরসভার অনুমতি ছাড়াই বেআইনি মাস্টার প্ল্যান বানিয়ে নিচ্ছেন। ক্রেতাকে ঠকাতে দু’পাশের জমির মাঝখানে চওড়া রাস্তা রয়েছে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে চড়া দামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে জমি।
কিন্তু কতটা রাস্তা রয়েছে? সে রাস্তা দিয়ে আদৌ দমকল বা অ্যাম্বুল্যান্স যেতে পারবে কিনা— এ সব দেখছেন না কেউ। জমির পরিমাণের উপর নির্ভর করে রাস্তা কতটা চওড়া হবে। সে ক্ষেত্রে যেখানে ২৫ ফুটের প্রধান রাস্তা হওয়া দরকার, সেখানে ১৬-১৮ ফুট রাস্তা রেখেই জমি বিক্রি হচ্ছে। ভিতরের ছোট ছোট রাস্তাগুলি ১৫ বা ১২ ফুট রাখা প্রয়োজন। সেখানে ৮-১০ ফুট রাস্তা রাখা হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারাই অভিযোগ করছেন, একদিকে জমির মালিক রাস্তা রয়েছে দেখিয়ে বেশি দাম নিচ্ছেন ক্রেতার কাছ থেকে। অন্য দিকে, রাস্তার জমি চুরি করে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বসত জমিতে। কোথাও প্ল্যানে দেখানো রাস্তা গিয়ে ঠেকছে কোনও অন্ধ গলিতে। পুরসভার দাবি, ১০-১২টি প্লটের ক্ষেত্রে এমন হলে ৩ শতাংশ জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। খাতায় কলমে সেই জরিমানাকে রাখা হচ্ছে উন্নয়ন খাতে। কিন্তু যে টাকাটি জমির মালিকের দেওয়ার কথা ছিল সেটি দিতে হচ্ছে ক্রেতাকে।
মেদিনীপুরের উপ-পুরপ্রধান জিতেন্দ্রনাথ দাস বলেন, “ছোটখাট জমির ক্ষেত্রে সামান্য জরিমানা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বড় জমি হলে তো ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারে। তাই ওই জমি বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছি।’’ তাঁর আশ্বাস, ভবিষ্যতে ছোটখাট জমিতেও যাতে এমন ঘটনা না ঘটে সে জন্য পদক্ষেপ করা হবে।
কিন্তু কেন তিন শতাংশ জরিমানাকে উন্নয়ন খাতে দেখানো হচ্ছে? উপ-পুরপ্রধানের কথায়, “যতক্ষণ না জমি বিক্রি হচ্ছে ততক্ষণ তো ধরার উপায় নেই। যাতে সাধারণ মানুষও এ বিষয়ে নজর রাখেন সে জন্যই তো জরিমানা।” তাঁর দাবি, রাস্তা, নিকাশি নালার জন্য জায়গা না-ছেড়েই বাড়ি তৈরি করতে চাইছেন এক শ্রেণির মানুষ। অথচ ওই সব এলাকায় তো নতুন করে নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে পুরসভাকেই। তাই এই জরিমানাকে উন্নয়ন খাতে দেখানো হচ্ছে।
মেদিনীপুর শহরে জমির দাম প্রতিদিন বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কাঠা প্রতি আড়াই-তিন লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ পর্যন্ত দাম হাঁকছেন মালিকরা। ফলে যাঁরা ভুল জমি কিনলেন, নামপত্তন করতে গিয়ে দেখলেন, তাঁদের জরিমানার পরিমাণটা অনেকখানি। তার আগে জানার উপায় নেই। সম্প্রতি এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী প্রতাপ চন্দ্রের। নামপত্তনের শুনানিতে গিয়ে জরিমানার কথা শুনে অবাক প্রতাপবাবু। তাঁর কথায়, “এমন নিয়মের কথা জানা ছিল না। ফলে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হল। কবে বাড়ি করতে পারব জানি না। তার আগেই এত টাকার ধাক্কা!” শিক্ষক সঞ্জয় পালেরও একই অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, “আমাদের পক্ষে কি পুরসভার এই সব নিয়ম জানা সম্ভব। দু’কাঠা জমি কিনেছিলাম। পুরসভা উন্নয়ন খাতে ২৮ হাজার টাকা নিল।”
কিন্তু এ তো গেল সাধারণ মানুষের জরিমানার কথা। বড় বিপদটি এর পরে। নতুন নতুন পাড়া গজিয়ে উঠছে, কিন্তু রাস্তা হচ্ছে সঙ্কীর্ণ। রাস্তার দু’পাশে নিকাশি নালা, জলের পাইপ লাইন তৈরির পর রাস্তা আরও সঙ্কীর্ণ হবে। ভবিষ্যতে ওই সব বসতি এলাকায় দমকল বা অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকবে কিনা সন্দেহ।
সব জেনেও পুরসভা কেন যথেষ্ট নজরদারি চালাচ্ছে কেন? কর্তৃপক্ষের দাবি, নজরদারি করা কঠিন। কেউ নিজের খুশি মতো মাস্টার প্ল্যান করছে জেনেও কিছু করার থাকে না। কারণ যতক্ষণ না তিনি জমি বিক্রি করছেন, ততক্ষণ তাঁকে ধরার উপায় নেই। উপ-পুরপ্রধান বলেন, “এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য পদক্ষেপ করা হবে। সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। তার জন্য আমরা প্রচারও করব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy