চিত্র ১: শেখ আবদুল মালেকের বাড়ি ঘাটালের শোলাগেড়িয়ায়।কর্মসূত্রে থাকেন দিল্লির সাহাপুরজাটে। সেখানে জরির কাজ করেন আবদুল।সম্প্রতি ছুটির দিনে দিল্লিতে বাড়ির বাইরে ঘোরাফেরা করছিলেন। এক জটলা দেখে দাঁড়িয়ে যান। অভিযোগ, স্থানীয়েরা চড়-থাপ্পড় মারে তাঁকে।
চিত্র ২: হানিফ আলি। বাড়ি চন্দ্রকোনার বেড়াবেড়িয়া গ্রামে। কাঠের কাজে গিয়ে ওড়িশার বালেশ্বর পুলিশের হাতে দিন দশেক আটক হয়েছিলেন ওই যুবক। নথি চাওয়ার নামে হয়রানির অভিযোগ ওঠে। তাঁকে ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। পরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ-প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বাড়িফিরেছেন হানিফ।
চিত্র ৩: কেউ বেকারি শিল্পে কর্মরত, কেউ দর্জি, কেউ বা রঙের কাজ করেন। এমনই কয়েকজন পরিযায়ীকে আচমকা অভিযান চালিয়ে ছত্তীসগঢ়ের রাইপুরের কোতোয়ালি সিটি পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন।দলে ছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের একাধিক পরিযায়ীও। সারাদিন থানায় রেখে কাগজপত্র জমা নেওয়ার পরে নানা ঝক্কি-ঝামেলা মিটিয়ে অবশেষে ছাড় পেয়েছেন তাঁরা।
কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা জারির পরেই ভিন্ রাজ্যে বাংলাভাষীদের এমন হেনস্থার অভিযোগ উঠছে। সোনার কাজ ছাড়াও অন্য নানা কাজে পশ্চিম মেদিনীপুরের বহু মানুষ ভিন্ রাজ্যে রয়েছেন। জেলার এই পরিযায়ীর সংখ্যা প্রায় আড়াই থেকে তিন লক্ষর। জরির কাজ, কাঠের আসবাব তৈরি, রঙের কাজ, প্লাস্টিক কারখানা, ওষুধ কারাখানায় শ্রমিকের কাজের পাশাপাশি নির্মাণ শিল্প, বেকারি, এমব্রয়ডারি, ফুলের কাজে যুক্ত পরিযায়ীরা। ভিন্ রাজ্যে কর্মরত জেলায় শ্রমিকদের ৭০ শতাংশই সোনা শিল্পের বাইরে কাজ করেন। স্বর্ণশিল্পে রাজ্য ওয়াড়ি একাধিক পোক্ত সংগঠন থাকলেও অন্য পেশার পরিযায়ীদের তেমন সংগঠন নেই। এঁদের অধিকাংশই ‘লেবার কন্ট্রাক্টর’ বা ঠিকা সংস্থার মাধ্যমে বা পরিচিতের সূত্রে বাইরে কাজে যান।
রুজির টানে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা জেলার এই পরিযায়ীদের উপরেই নথিপত্র চাওয়ার নামে কার্যত অত্যাচার চলছে বলে অভিযোগ।ভারতীয় প্রমাণ করতে মোবাইলে বাড়ির ছবি দেখানো, গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্যের সঙ্গে ফোনে কথা বলানো, বিদ্যুতের বিল, স্কুলের শংসাপত্র, জন্মের শংসাপত্র দেখাতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার নির্মাণ কর্মী, জরির শিল্পীদের পুলিশ ভেরিফিকেশন জমা দিতে হচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্য তাদের মতো করে ফর্ম ছাপিয়েছে। তা পূরণ করতে গিয়েও হাজারো নথির তথ্য দিতে হচ্ছে। ফাঁক ফোকর থাকলে রেহাই মিলছে না বলে অভিযোগ দিল্লি, ছত্তীসগঢ়ের রাইপুর, রাজস্থান, ওড়িশা, তেলেঙ্গানা,ইন্দোর, বিহার, গুজরাতের সুরাত, কর্নাটক-সহ নানা রাজ্যে চলছে নথি যাচাই। কখনও কর্মস্থলে, কখনও আবাসনে চলছে পুলিশি অভিযান।
ওড়িশায় হেনস্থার শিকার হওয়া চন্দ্রকোনার হানিফ বলছিলেন, “আমাকে ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছিল। প্রথম দিন ভেবেছিলাম, যা নথিপত্র চাইছে, হয়তো আর বাড়ি ফেরা হবে না। আধার, ভোটার কার্ডে গুরুত্ব দিচ্ছে না। জন্মের শংসাপত্ত, পঞ্চায়েতের শংসাপত্র, পুলিশ সার্টিফিকেটও দিতে হচ্ছে।” দিল্লিতে জরির কাজে যুক্ত ঘাটালের দিলসাদ আলির কথায়, “২০ বছর দিল্লিতে আছি। এতদিন কোনও কাগজপত্র নিয়ে ঝামেলা হয়নি।” কর্মসূত্রে ছত্তীসগড়ের রাইপুরে থাকা দাসপুরের ইসমাইল মল্লিকের মতে, “নথিপত্র জমা নিক। কিন্তু নথির নামে কোন গ্রামে থাকি, গ্রামের দশজনের নাম ও ফোন নম্বর, বাড়ির মৌজা, দাগ নম্বর, পুলিশ ভেরিফিকেশন দিকে হবে কেন?” দিল্লিতে কর্মরত কেশপুরের নাসিমউদ্দিনও বলেন, “একে কাজের নিশ্চয়তা নেই। তায় নথির নামে এত ঝক্কি!’’ (চলবে)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)