ঘাটালের একটি ব্যাঙ্কে গ্রাহকদের লম্বা লাইন। কৌশিক সাঁতরার তোলা ছবি।
ভাঙা ইট, ফেলে দেওয়া জলের বোতল, ছেঁড়া জুতো— এখন অনেক দাম। সকাল সকাল বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকায়।
দোকানে নয়। ব্যাঙ্কের সামনে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও ব্যাঙ্কে ঢুকতেই পারছেন না বহু গ্রাহক। ঢুকলেও অনেক সময় ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে পিছপা নন এক শ্রেণির মানুষ। এখন তাঁদের দম ফেলার সময় নেই। রাতে ইট বা জলের বোতল দিয়ে নাম লেখা চিরকুট চাপা দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। যাঁর নাম লেখা তিনি আসবেন সকালে, ব্যাঙ্ক খোলার ঠিক আগে। ইট সরিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়বেন।
বৃহস্পতিবারই ৪০০ টাকা দিয়ে কুড়ি জনের পর লাইনে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলেন ঘাটালের কোন্নগর এলাকার ব্যবসায়ী তুষার ঘোষ। তিনি বলেন, “টাকা জমা দেওয়ার জন্য দু’দিন ধরে ঘুরছি। এত ভিড়! ওই লাইনে দাঁড়ালে দোকান বন্ধ করে দিতে হবে। বাধ্য হয়ে ৪০০ টাকা দিয়েই ‘লাইন’ কিনলাম।” দাসপুরের গোপীগঞ্জের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে লাইন দিয়েছিলেন কাজল মাল। সামনে মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা তুলতে এসেছিলেন তিনি। বলেন, “একেই সময় নেই। সমস্ত জোগাড় নিজেকেই করতে হচ্ছে। তাই এ দিন ৩০০ টাকা দিয়েই ‘ভাঙা ইট’ কিনে ব্যাঙ্কের কাজ সারলাম।”
আর যাঁরা রাত জেগে ইট দিয়ে লাইন রাখলেন তাঁরা পেলেন কড়কড়ে টাকা। এক সপ্তাহ দিব্যি চলছে রোজগার। শুধু তাই নয়। অনেকেই ওই কড়কড়ে খুচরো টাকা দিয়ে ভাঙিয়ে দিচ্ছেন ৫০০ -১০০০ টাকার নোটও। বুধবার পর্যন্ত ঘাটাল শহরে কোনও ব্যাঙ্কে টাকা বদল করার জন্য কালি লাগানোর ব্যবস্থা ছিল না। ফলে কুশপাতার দুই যুবক বুক ফুলিয়ে বলেই ফেললেন, ‘‘মোদীজি ভালই করছেন। আমরা যে খুচরো টাকা রোজগার করছি লাইন রেখে, তা দিয়েই মানুষকে ভাঙিয়ে দিচ্ছি ৫০০-১০০০ টাকার নোট। ব্যাঙ্কে গেলে তো আমাদের নোট বদল হয়ে যাচ্ছেই।’’
এ সবই অবশ্য পুলিশ বা ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ কেউই জানেন না বলে দাবি করেছেন। স্টেট ব্যাঙ্কের ঘাটাল শাখার চিফ ম্যানেজার সুব্রত বিশ্বাস বলেন, “ব্যাঙ্কের বাইরে কী হচ্ছে তার দায় আমাদের নয়। আমরা গ্রাহকদের পরিষেবা দিচ্ছি। ব্যাঙ্কের নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়াও পুলিশ আমাদের সাহায্য করছে। কোনও সমস্যা তো হচ্ছে না।”
সমস্যাটা অবশ্য ব্যাঙ্কের ভিতর থেকে বোঝার কথাও নয়। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহকুমার এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বললেন, “ব্যাঙ্কের মুখে ইট-জলের বোতল পড়ে রয়েছে দেখছি। ফলে বিষয়টিও পরিষ্কার। আমরা সবই জানি। কিন্তু বিষয়টি পুরোপুরি গ্রাহকদের। কিছু বলার নেই।”
প্রধানমন্ত্রী ৫০০ এবং ১০০০ টাকা নোট বাতিল ঘোষণা করার পরই দেশ জুড়ে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক গুলিতে লম্বা লাইন। পুরোন নোট জমা দেওয়া এবং টাকা তোলার জন্যই ভিড় করছেন গ্রাহকেরা। যত দিন যাচ্ছে, ততই ভিড় বাড়ছে ব্যাঙ্কগুলিতে। কোনও কোনও ব্যাঙ্কের শাখায় গ্রাহকের লাইন যাচ্ছে এক-দেড় কিলোমিটার। চাপ সামালতে হিমসিম পুলিশ। তার উপর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষণায় নোট জমা নেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কগুলিতে। ক্রমশ চাপ বাড়ছে ব্যাঙ্কের উপর।
লম্বা লাইনে মানুষের হয়রানির সুযোগ নিচ্ছেন বহু বেকার যুবক। ইট দিয়ে লাইন বিক্রি করছেন মহিলারাও। ঘাটাল শহর-সহ গ্রাম-গঞ্জের কমবেশি সব শাখার সামনেই শতাধিক ইট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। তিন-চার ঘন্টায় পকেটে ঢুকে গিয়েছে দেড়-দু’হাজার টাকা। কাজ মিটে গেলেই জলের বোতল এবং ছেঁড়া জুতোগুলি ব্যাগে পুরে বাড়ি ফিরছেন ‘বিক্রেতারা’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy