Advertisement
E-Paper

আগুনও চিড় ধরাতে পারেনি সুমিত্রার ইচ্ছায়

মাত্র তিন বছর বয়সে আগুনে পুড়েছে শরীর। ডান হাতের চারটি আঙুল অসাড়। কিন্তু মনের জোরে এতটুকুও চিড় ধরেনি সুমিত্রা রাণা’র। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম ব্লকের পাইকা গ্রামের বছর উনিশের এই তরুণী এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছেন।

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৪ ০০:৪৮
পরীক্ষার পরে সুমিত্রা রাণা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

পরীক্ষার পরে সুমিত্রা রাণা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

মাত্র তিন বছর বয়সে আগুনে পুড়েছে শরীর। ডান হাতের চারটি আঙুল অসাড়। কিন্তু মনের জোরে এতটুকুও চিড় ধরেনি সুমিত্রা রাণা’র। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম ব্লকের পাইকা গ্রামের বছর উনিশের এই তরুণী এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছেন। মধ্যমা ও তর্জনীর ফাঁকে পেন গুজে লেখেন সুমিত্রা। লেখার সময় যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায় শরীর। কিন্তু অদম্য ইচ্ছা ও মানসিক দৃঢ়তার কাছে হার মেনেছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। নয়াগ্রামের শালগেড়িয়া সিডিউল অ্যাকাডেমির ছাত্রী সুমিত্রা এবার পরীক্ষা দিচ্ছেন স্থানীয় খড়িকা ভীমার্জুন মহাকুল এসসি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষাকেন্দ্রে। পরীক্ষাকেন্দ্রের সুপারভাইজার অনুপকুমার জানা বলেন, “প্রথম দিন ওই পরীক্ষার্থীকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। দু’টি আঙুলের ফাঁকে পেন গুঁজে দ্রুত উত্তরপত্রে লেখা সহজ-কাজ নয়। লেখার সময় যন্ত্রণায় সুমিত্রার দু’চোখ জলে ভরে যায়। কিন্তু হাতের লেখাটি মুক্তের মতো।”

মঙ্গলবার খড়িকার ওই পরীক্ষাকেন্দ্রে পুষ্টিবিদ্যা পরীক্ষা দেওয়ার পরে সুমিত্রা কথা বললেন আনন্দবাজারের সঙ্গে। পাইকা গ্রামে টিনের ছাউনি দেওয়া এক চিলতে মাটির বাড়িতে বাবা, মা ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন সুমিত্রা। বড় দাদা পঞ্জাবের একটি সুতো কলে কাজ করেন। সুমিত্রার বাবা কানাই রাণা পেশায় দিনমজুর। মা সরোজিনীদেবী গৃহবধৃ। দু’জনেই পড়াশোনা নিরক্ষর। অভাবের সংসারে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালানোর ক্ষমতা নেই রানা-দম্পতির। তাই পঞ্চম শ্রেণির পর সুমিত্রার বড় দাদাকে স্কুলের পাট চুকিয়ে ভিন রাজ্যে কারখানায় শ্রমিকের কাজে যেতে হয়েছে। সুমিত্রার সেজ ভাই অনিলও স্কুলছুট। কেবল ছোট ভাই সুনীল শালগেড়িয়া সিডিউল অ্যাকাডেমিতে নবম শ্রেণিতে পড়ে। সুমিত্রার যখন তিন বছর বয়স সেই সময়ে দুর্ঘটনায় তাঁর শরীরের বেশ কিছু অংশ পুড়ে যায়। সরোজিনীদেবী জানালেন, উনুনে কাঠের আঁচ ছিল। অসতর্ক মুহূর্তে ছুটে যাওয়ার সময় উনুনের উপর পড়ে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হন সুমিত্রা। মুখ ও দু’টি হাত-সহ শরীরের কিছুটা অংশ পুড়ে যায়। অভাবের সংসারে মেয়ের পরবর্তীকালীন উপযুক্ত চিকিত্‌সা করাতে পারেন নি কানাইবাবু।

ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক সুমিত্রার। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে স্থানীয় শালগেড়িয়া সিডিউল অ্যাকাডেমি থেকে ২০১২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয় সুমিত্রা। ওই স্কুলেই কলা বিভাগে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ার পরে এবার উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছেন। সুমিত্রার কথায়, “গৃহ শিক্ষক নেই। দাদা পঞ্জাব থেকে মাঝে মধ্যে যে সামান্য টাকা পাঠায়তা দিয়ে বইখাতা কিনে পড়ার খরচ চালাই।” কানাইবাবু ও সরোজিনীদেবী জানাচ্ছেন, “আগুনে পুড়ে গিয়ে মেয়ের বাম হাতের চেটো ও আঙুলগুলি দলা পাকিয়ে গিয়েছে। ডান হাতের চারটি আঙুল অসাড়। কেবলমাত্র মধ্যমা ও তর্জনী দু’টি সামান্য নাড়াতে পারে সুমিত্রা। ছোটবেলায় আঙুলের ফাঁকে চক ও পেন্সিল গুঁজে লেখা অভ্যাস করত। নিজের জেদেই পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন তিন-চারঘন্টা লেখা অভ্যাস করে।” সুমিত্রা বলেন, “আজ পর্যন্ত কোনও সরকারি সাহায্য পাই নি। তবে লেখাপড়া ছাড়ব না। আগুন আমার শরীর পুড়িয়েছে, কিন্তু স্বপ্নকে পোড়াতে পারে নি। ভবিষ্যতে শিক্ষিকা হতে চাই।” সুমিত্রার সব সময়ের সঙ্গী রবীন্দ্রনাথ। মন কেমন করলে গেয়ে ওঠেন, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে...’। ‘আগুন-মেয়ের’ অন্তরে জ্ঞানের আলোক শিখাটি

যে অনির্বাণ!

sumitra rana pashim medinipur nayagram block kinshuk gupta jhargram
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy