সিএসএ মাঠে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ নিচ্ছে হাতে গোনা কয়েকজন খুদে।
চিত্র এক: কাঁথি মহকুমা ক্রীড়া সংস্থা পরিচালিত চলতি বছরের সিনিয়ার ফুটবল লিগ প্রতিযোগিতা হবে। দিন কয়েক ধরেই চলছে বিভিন্ন ক্লাবের নাম লেখানো। কিন্তু তেমন যেন উদ্দীপনা নেই। নাম লেখানোর শেষ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল, এ বারের প্রতিযোগী ক্লাবের সংখ্যা মাত্র ছয়!
এমন দৈন্য দশায় প্রতিযোগিতাটাই হবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় খোদ মহকুমা ক্রীড়া সংস্থা।
চিত্র দুই: বিগত এক বছর ধরে ফাঁকাই পড়ে রয়েছে মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের পদ। বছরখানেক হল সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অশোক দাসপট্টনায়ক পদত্যাগ করেছেন। মাঝে কেটে গিয়েছে একটা বছর। নতুন করে ওই পদে এখনও পর্যন্ত কেউ বহাল হননি। ফলে সাধারণ সম্পাদক ছাড়াই চলছে মহকুমা ক্রীড়া সংস্থা।
এই দু’টি ছবিই বুঝিয়ে দিচ্ছে কাঁথি খেলাধুলো চর্চা ঠিক কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।
অথচ ছবিটা কিন্তু কখনও এমনটা ছিল না। তিনের দশকে ব্রিটিশ আমলে কাঁথিতে তেমন কোন মাঠ ছিল না। তাই খেলার মাঠ নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে স্থানীয় যুবকদের বিরোধ বেধেছিল। তাই প্রয়াত খগেন্দ্রনাথ শাসমল, সতীশচন্দ্র জানা, সুরেন্দ্রনাথ প্রধান, মনোজ কুমার সিংহ ও শ্রী গোবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ১৯৩০ সালে কাঁথিতে মাঠ তৈরি হয়। মাঠের জন্য কাঁথির করকুলি মৌজার প্রয়াত হেমনাথ দত্ত ২ একর ৪০ ডেসিমেল জমি দান করেন। সেই জমিই আজ কাঁথি মহকুমার ক্রীড়া সংস্থার নিজস্ব মাঠ হিসেবে পরিচিত। ১৯৩২ সালে সরকারিভাবে কাঁথি স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন বা সিএসএ গঠিত হয়। ১৯৭২ সালে সেটাই হয়ে যায় কাঁথি মহকুমা ক্রীড়া সংস্থা। আগে অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে সারা বছর ধরে কাঁথিতে একাধিক ফুটবল প্রতিযোগিতা হত। তাতে যোগ দিতে শুধু এলাকার দল নয়, আসত ভিন জেলা, এমনকী ভিন রাজ্যের দলও। খেলা দেখতে জনতার উৎসাহও ছিল চোখে পড়ার মতো। কাঁথি থেকে অনেক তরুণ ফুটবলার কলকাতার প্রথম ডিভিশনের দলগুলিতে নিয়মিত খেলেছেন। এদের মধ্যে বিশ্বজিৎ বেরা, মন্মথনাথ মাইতি, মুকুন্দ বারিকের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। শুধু ফুটবলই নয় একসময় কাঁথিতে টেনিস সাঁতার, ওয়াটার পোলো, ডাইভিং এমনকি ক্রিকেট খেলার নিয়মিত চর্চা ছিল বলে জানিয়েছেন কাঁথির অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অমলেশ মিশ্র। স্ম্ৃতি হাঁতড়ে তিনি বলেন, “কাঁথির খাসমহল মাঠে টেনিস কোর্ট ছাড়াও সেচ দফতরের অফিস প্রাঙ্গণেও টেনিস কোর্ট ছিল। সেখানে নিয়মিত ভাবে খেলতে আসতেন তৎকালীন সরকারি আধিকারিকরা।
তাহলে বর্তমান শহরের তরুণ-তরুণীরা কেন মুখ ফেরাচ্ছে খেলা থেকে? কেনই বা বিকেলে খেলার মাঠগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে? এর পিছনে শুধুই দায়ী কিশোর-কিশোরীদের সময়ের অভাব? আর টিউশনির চাপ? পরিকাঠামো নিয়ে কী বলছে নতুন প্রজন্ম?
কাঁথি মহকুমা বিদ্যালয় ক্রীড়া সংস্থার তত্ত্বাবধানে মহকুমার মাধ্যমিক, ও উচ্চমাধ্যমিক ও মাদ্রাসা বিদ্যালয়গুলির ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলি পরিচালিত হয়ে থাকে। গত কয়েক বছরে অধিকাংশ বিদ্যালয়গুলি প্রতিযোগিতায় যোগ দিচ্ছে না বলে অভিযোগ। সংস্থার সম্পাদক বলেন, “দেশের পরাধীনতার সময় কাঁথি মহকুমা বিদ্যালয় ক্রীড়া সংস্থার জন্ম হলেও সংস্থার আজ পর্যন্ত নিজস্ব অফিসঘর হয়নি।” কাঁথি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অরূপকুমার দাস বলেন, “লিগ চললে অনেক দিন নষ্ট হয়। এখনকার পড়ুয়ারা পড়াশোনায় অত্যন্ত সচেতন। ফলে দূরে খেলতে যাওয়ার আগ্রহ কম।” কী বলছে নতুন প্রজন্ম? ইমন মান্না, সঞ্জীব চক্রবর্তী, বিশ্বজ্যোতি দাসের কথায়, “পড়ার চাপ আগের থেকে বেড়ে গিয়েছ। বিকেলেও পড়া থাকে। আর সময় পেলে একটু কম্পিউটার করি।” শহরের ‘সুভাষ ব্যায়ামাগার’ বতর্মান সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর অর্থানুকূল্যে পরিণত হয়েছে আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক জিমে। কিন্তু সেখানেও আগ্রহীদের সংখ্যা খুবই কম। ব্যায়ামাগারের অন্যতম সদস্য ও কর্মকর্তা দিলীপ খান্ডার আক্ষেপ, “আজকের ছেলেমেয়েরা কম্পিউটার, মোবাইল আর সোস্যাল নেট ওয়ার্কিং সাইট নিয়েই বেশি ব্যস্ত। শরীরচর্চা বা খেলাধুলার দিকে নজর দেওয়ার সময় কোথায়?”
অরবিন্দ স্টেডিয়ামে সংস্কার কাজ চলায় খেলা বন্ধ। ছবি: সোহম গুহ।
কাঁথি মহকুমা বিদ্যালয় ক্রীড়া সংস্থার সংস্থার সম্পাদক স্বপন দাসের অভিযোগ, “শহরে মহকুমাক্রীড়া সংস্থার মাঠ ছাড়া অরবিন্দ স্টেডিয়াম রয়েছে। তবে সেখানে খেলাধুলার অনুষ্ঠানের বদলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশ আর বিচিত্রানুষ্ঠানের কাজেই লাগে বেশি।” তবে এই অভিযোগ মানতে চাননি কাঁথির বিধায়ক দিব্যেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, “অরবিন্দ স্টেডিয়ামে সংস্কারের কাজ চলছে। প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে স্টেডিয়ামের মাঠের আধুনিকীকরণ, নিকাশি ব্যবস্থা ও গ্যালারির সংস্কারের কাজ ছাড়াও ১৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নানা কাজ চলছে।” দিব্যেন্দুবাবু আরও জানান, কাঁথির খাসমহল মাঠের দিঘিকে সুইমিং পুল করার চিন্তাভাবনা নিয়ে বিধায়ক তহবিল থেকে ১৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
কাঁথিতে মহকুমা ক্রীড়া সংস্থা ও কাঁথি পুরসভার উদ্যোগে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল বা সিএবির উদ্যোগে একটি ক্রিকেট প্রশিক্ষণ শিবির চালানো হয়। সেখানে স্কুল স্তরের অনেক খুদেই প্রশিক্ষণও নিতে আসে। তবে সংখ্যাটা খুব বেশি নয়। অনেকে আবার তার মধ্যে মূল প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে বলেও জানান মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার ক্রীড়া সম্পাদক বিশ্বজিৎ দত্ত। সঙ্গে সংযোজন, “সামনের মরসুমে যাতে ফুটবলের প্রশিক্ষণ শিবির করা যায়, তার চেষ্টাও চলছে।” আশা দেখাচ্ছে সেটুকুই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy