Advertisement
১৯ মে ২০২৪

গাছে শিক্ষিকার দেহ, খুনে অভিযুক্ত স্বামী-সহ আট

স্ত্রী প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। স্বামী হাই স্কুলের শিক্ষক। তা বলে পণের জন্য স্ত্রীয়ের উপর নির্যাতন বন্ধ থাকেনি। বছর তিনেক আগে কন্যা সন্তান হওয়ার পর আরও বাড়ে অত্যাচার। সোমবার রাতে স্ত্রীর ঝুলন্ত দেহ পাওয়া গেল বাড়ির পাশের গাছে। ঘরের মেঝেয় রক্ত, আঁচড়ের দাগ, আর মৃতদেহের নখের তলায় মাটি দেখে খুনের মামলা দায়ের করল বধূর পরিবার। স্বামী পলাতক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
খড়্গপুর শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৪ ০১:০৪
Share: Save:

স্ত্রী প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। স্বামী হাই স্কুলের শিক্ষক। তা বলে পণের জন্য স্ত্রীয়ের উপর নির্যাতন বন্ধ থাকেনি। বছর তিনেক আগে কন্যা সন্তান হওয়ার পর আরও বাড়ে অত্যাচার। সোমবার রাতে স্ত্রীর ঝুলন্ত দেহ পাওয়া গেল বাড়ির পাশের গাছে। ঘরের মেঝেয় রক্ত, আঁচড়ের দাগ, আর মৃতদেহের নখের তলায় মাটি দেখে খুনের মামলা দায়ের করল বধূর পরিবার। স্বামী পলাতক। খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাদনা বরুণ চন্দ্রশেখর বলেন, “ঘটনায় মৃতের বাপের বাড়ির তরফে অভিযোগে খুনের মামলা রুজু হয়েছে। তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সব দিক খতিয়ে দেখে ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে।”

মঙ্গলবার ডেবরা ব্লকের জলিবান্দা গ্রাম পঞ্চায়েতের আম্বিদীঘিতে সুপ্রিয়া ধাড়া মান্নার (৩১) মৃত্যু ফের পণপ্রথার ভয়াবহতাকে সামনে নিয়ে এল। সুপ্রিয়া ওই গ্রামেরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। তাঁর স্বামী-সহ শ্বশুরবাড়ির আট জনের নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন তাঁর ভাই। শ্বশুরবাড়ির শাস্তির দাবিতে মৃতদেহ আটকে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারাও। ভাঙচুরও চালানো হয় মৃতার শ্বশুরবাড়িতে। পুলিশ এসে মৃতার শ্বশুর, শাশুড়ি ও নন্দাইকে গ্রেফতার করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৬ সালে সবংয়ের দশগ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা চাকরি পেয়েছিলেন সুপ্রিয়াদেবী। ২০০৮ সালে খড়্গপুর গ্রামীণের রাউতমণির বাসিন্দা সুপ্রিয়াদেবীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আম্বিদীঘির বাসিন্দা হাইস্কুল শিক্ষক সারথি মান্নার। সুপ্রিয়াদেবীর পরিবারের অভিযোগ, বিয়ের এক বছর পর থেকেই টাকা ও গয়নার দাবিতে তাঁর ওপর নির্যাতন চলত। এমনকী সুপ্রিয়াদেবীর চাকরি নিয়েও আপত্তি জানিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা। বছর তিনেক আগে কন্যা সন্তান হওয়ার পর থেকে অত্যাচার আরও বাড়তে থাকে। সেই সময় দশগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আম্বিদীঘিতে বদলি হয়ে আসেন সুপ্রিয়াদেবী। গত সোমবার রাত তিনটে নাগাদ সুপ্রিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে বাপের বাড়িতে ফোন করেন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। চিন্তিত হয়ে খোঁজ শুরু করেন বাপের বাড়ির লোকেরাও। কিন্তু খোঁজ মেলেনি। কিছু পরেই আবার তাঁদের জানানো হয় সুপ্রিয়ার খোঁজ মিলেছে। মঙ্গলবার ভোরে মৃতার ভাই-সহ পরিজনেরা এসে দেখেন শ্বশুরবাড়ির কাছেই বাগানের একটা গাছ থেকে ঝুলছে সুপ্রিয়াদেবীর দেহ।

মৃতার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বললেও বাপের বাড়ির লোকেরা তা মানতে নারাজ। সুপ্রিয়াদেবীর পরিবারের দাবি, মৃতদেহে শুধুমাত্র গলায় নয়, কোমর থেকে গলা পর্যন্ত শাড়ির ফাঁস ছিল। এছাড়াও বাড়ির ভিতরে রক্তের দাগ ও মেঝেতে পড়ে থাকা মাটিতে আঁচড়ের দাগ রয়েছে। আবার সুপ্রিয়াদেবীর নখেও মাটি লেগে রয়েছে। তাই এটা আত্মহত্যা নয়, খুন। মঙ্গলবার বিকেলে মেয়ের মৃত্যুর খবর জানতে পেরে সুপ্রিয়াদেবীর বাবা অশোক ধারা বলেন, “সুপ্রিয়া মেয়েকে খুব ভালবাসত। সাংসারিক অত্যাচারে রোজ মেয়েকে নিয়ে ওকে স্কুলে যেতে হত। বছর খানেক আগে জমি কেনার জন্য আমার মেয়ের মারফত জামাই দেড় লক্ষ টাকার জন্য চাপ দিচ্ছিল।” মৃতার ভাই সুভাষচন্দ্র বেরা বলেন, “আমার দিদির ওপর বিয়ের পর থেকেই পণের দাবিতে নির্যাতন চলত। ওঁর চাকরি করাও পছন্দ ছিল না। দিদি কান্নাকাটি করলেও আমরা বুঝিয়ে পাঠাতাম। ওঁকে শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছে।” এরপরই মৃতার স্বামী সারথি মান্না, শ্বশুর নারায়ণচন্দ্র মান্না, শাশুড়ি প্রভাবতী মান্না-সহ আট জনের নামে ডেবরা থানায় বধূ হত্যার অভিযোগ দায়ের করা হয়।

এ দিকে অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে মৃতদেহ ঘিরে সকাল ৯টা থেকে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বিক্ষোভ চলে দুপুর ১টা পর্যন্ত। সেই সময় বাড়িতে ছিলেন মৃতার শাশুড়ি প্রভাবতী মান্না। তাঁর কথায়, “রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সবাই শুতে চলে যায়। ছেলেরা খেলা দেখছিল। পরে সারথি এসে বলল সুপ্রিয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক খোঁজার পর গাছে ঝুলছে দেখলাম সুপ্রিয়ার দেহ।” যদিও এসব দাবি মানতে নারাজ গ্রামবাসীরা। গ্রামের গুরুপদ বেরা, খগেন মান্না, চক্রধারী মান্নারা বলেন, “ওই পরিবারের সঙ্গে গ্রামের কোনও লোকের সম্পর্ক ভাল নয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কী অশান্তি হত জানা নেই। তবে দেহ দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা খুন।” এ দিন মৃতার শ্বশুরবাড়ির পাওয়ার টিলার ও একটি মোটরসাইকেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ভাঙচুর চালানো হয় মৃতার শ্বশুরবাড়িতেও। বাড়ির আসবাবপত্র ভেঙে দেওয়া হয়।

বিক্ষোভের পর ঘটনাস্থল থেকে পালান স্বামী-সহ অভিযুক্তরা। তবে গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়ে যান মৃতার নন্দাই শশাঙ্ক জানা ও তার ছেলে মনু জানা। তাঁদের হাতের কাছে পেয়ে মারধর শুরু করে উত্তেজিত জনতা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান খড়্গপুরের এসডিপিও সন্তোষ মণ্ডল। গ্রেফতার করা হয় মৃতার শ্বশুর, শাশুড়ি ও নন্দাইকে। সুপ্রিয়াদেবীর দু’বছরের মেয়ে সৌমিলি রয়েছে তার মামারবাড়িতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE