Advertisement
E-Paper

জীর্ণ আবাসন, নিকাশির অভাবে ছড়াচ্ছে দূষণ

স্ত্রী রেলকর্মী। তাই রেলের কোয়ার্টারেই থাকেন বেসরকারি সংস্থার কর্মী বছর পঁয়ত্রিশের সন্তোষ কুমার। গত ১৮ জানুয়ারি স্ত্রী সীতা কোনা বাপের বাড়িতে গিয়েছিলেন। রাতে বাবার সঙ্গে শুয়েছিলেন সন্তোষ। রাত দু’টোয় ঘুম ভেঙে চিত্‌কার করে ওঠেন বাবা-ছেলে। কারণ, ভেঙে পড়েছে জীর্ণ কোয়ার্টারের কার্নিশ। সন্তোষের মাথা ফেটে রক্ত বেরোতে শুরু করে।

দেবমাল্য বাগচি

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৩৮
খড়্গপুরের রেল আবাসনের জীর্ণ দশা। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।

খড়্গপুরের রেল আবাসনের জীর্ণ দশা। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।

স্ত্রী রেলকর্মী। তাই রেলের কোয়ার্টারেই থাকেন বেসরকারি সংস্থার কর্মী বছর পঁয়ত্রিশের সন্তোষ কুমার। গত ১৮ জানুয়ারি স্ত্রী সীতা কোনা বাপের বাড়িতে গিয়েছিলেন। রাতে বাবার সঙ্গে শুয়েছিলেন সন্তোষ। রাত দু’টোয় ঘুম ভেঙে চিত্‌কার করে ওঠেন বাবা-ছেলে। কারণ, ভেঙে পড়েছে জীর্ণ কোয়ার্টারের কার্নিশ। সন্তোষের মাথা ফেটে রক্ত বেরোতে শুরু করে।

এই দশা রেলশহর খড়্গপুরের মথুরাকাটি এলাকার এমএস টাইপ কোয়ার্টারের। শুধু সন্তোষ নয়, যে কোনও সময় দুর্ঘটনায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে রেলের পুরনো কলোনি এলাকার প্রায় এক হাজার পরিবার। মথুরাকাটির বি টাইপ, নিমপুরার আড়াই নম্বর এলাকাতেও রেল কোয়ার্টারে ভগ্নদশা। রয়েছে নিকাশির সমস্যাও। অথচ মাস গেলেই বেতনের টাকা থেকে নিয়মমাফিক ঘরভাড়ার টাকা কেটে নেন রেল কর্তৃপক্ষ। সমস্যা সমাধানে রেলকর্মীরা ছুটে যাচ্ছেন রেলের ওয়ার্ক্স বিভাগ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ অথবা স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের দফতরে। দরবার চলছে খোদ ডিভিশনাল ম্যানেজারের কাছেও। কিন্তু কোয়ার্টারের হাল ফিরছে না। বাসিন্দাদের অভিযোগ, চাপের মুখে মেরামতির কাজ করলেও তা ভাল ভাবে হচ্ছে না। জোড়া-তালি দিয়ে চলে যাচ্ছেন রেলের ঠিকাসংস্থার শ্রমিকেরা।

১৮৯৮ সালে এশিয়ার সব থেকে বড় রেল কারখানা গড়ে ওঠার সূত্রেই ঘনবসতি গড়ে ওঠে খড়্গপুরে। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ সাহেবদের জন্য বাংলো ছিল শহরের দক্ষিণ প্রান্তে বাংলো সাইড এলাকায়। ক্রমে কাজের সন্ধানে বিভিন্ন রাজ্য থেকে বহু মানুষ এখানে আসেন। শ্রমিকের সংখ্যা বাড়তে থাকায় প্রয়োজনীতা বাড়ে রেল কলোনির। সেই মতো নিমপুরা, মথুরাকাটি, ওল্ড সেটলমেন্ট, এক নম্বর, দু’নম্বর, গোলখুলি-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় রেলের কোয়ার্টার তৈরি হয়। এখন এই রেলশহরে প্রায় ১৩ হাজার রেল কোয়ার্টার রয়েছে। ডিভিশন ও রেল কারখানা মিলিয়ে প্রায় ৩১ হাজার কর্মী কাজ করেন খড়্গপুর রেলে। অবশ্য এঁদের একাংশ ডিভিশনের অধীনে হলদিয়া, সাঁতরাগাছি-সহ বিভিন্ন এলাকায় থাকেন। আবার অনেকে খড়্গপুরেই নিজস্ব বাড়ি বানিয়েছেন। তবে এখনও রেলকর্মীদের একটা বড় অংশই থাকেন কোয়ার্টারে। সেগুলির বেশিরভাগেরই অবস্থা জরাজীর্ণ।

নিয়ম অনুযায়ী বেহাল কোয়ার্টার সারানোর কথা রেলের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের। সে ক্ষেত্রে বিপজ্জনক কোয়ার্টারগুলি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আর পরিত্যক্ত কোয়ার্টার ভেঙে সেখানে নতুন কোয়ার্টার বা উন্নয়নমূলক অন্য কাজ করে থাকে রেল। ২০০৯ সাল নাগাদ এক নম্বর রেল কলোনি এলাকায় প্রায় তিনশো কোয়ার্টার ভাঙা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে আর কিছু তৈরি হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা এল রাও বলেন, “ভেবেছিলাম এলাকায় নতুন কোয়ার্টার হবে। কিন্তু কোথায় কী!”

মথুরাকাটির রেল কলোনি এলাকার এমএস টাইপ এবং বি টাইপ কোয়ার্টারে থাকে প্রায় পাঁচশো পরিবার। সেখানে নিকাশির কোনও সুষ্ঠু ব্যবস্থাই নেই। অধিকাংশ কোয়ার্টারের দেওয়ালে জন্মেছে আগাছা। খসে পড়েছে পলেস্তারা, খুলে যাচ্ছে ইট ও লোহার রড। কোয়ার্টারের ভিতরে কোথাও ফেঁপে গিয়েছে ছাদ তো কোথাও সামান্য বৃষ্টিতেই ছাদ থেকেই চুঁইয়ে পড়ে জল। এমএস টাইপ কোয়ার্টারের বাসিন্দা আরপিএফ দিলীপকুমার নায়েক, বি টাইপের রেলকর্মী এ শ্রীনিবাস রাওয়ের কথায়, “কোয়ার্টারগুলি পুরোদস্তুর মেরামত করা প্রয়োজন। একসঙ্গে ১২-১৫টি অভিযোগ পেলে দু’বছর পর টেন্ডার ডেকে কাজ করতে আসছে রেল। কিন্তু সামান্য কাজ করেই অর্থাভাব বলে চলে যাচ্ছে। প্রতি মাসে ভাড়া দিলেও কেন টাকা থাকেনা সেটাই প্রশ্ন?”

সংস্কারের অভাবে কোয়ার্টার চত্বরের নালাগুলিও বুজে গিয়েছে। কোথাও আবার সেপটিক ট্যাঙ্কের ঢাকনা ভেঙে গিয়ে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। এসএস টাইপের একটি কোয়ার্টারের বাসিন্দা শম্পা রাণা বলেন, “স্বামী রেলে চাকরি করেন। ৪ বছর ধরে এখানে আছি। কোনওদিন জঞ্জাল সাফাই হয় না। আমরা বাড়তি টাকা দিয়ে সাফাইকর্মী ডেকে এনে অনেক সময় আবর্জনা পরিষ্কার করি।” একই অবস্থা নিমপুরার আড়াই নম্বর রেল কলোনি এলাকার। বহু প্রাচীন এই এলাকার প্রতিটি কোয়ার্টার একত লা। এখানে প্রায় সাড়ে চারশো পরিবার থাকলেও ভবন জীর্ণ, নিকাশির জল বাড়ির আশপাশেই জমে থাকে। পোকামাড়রের সঙ্গে দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকার বাসিন্দা রেলকর্মী শঙ্কর রাও বলেন, “নিজেদের উদ্যোগে কোয়ার্টার রং করি।”

২০১০ সালে এলাকা পুনর্বিন্যাসে রেলশহরের ৮টি ওয়ার্ড পুরসভার অধীনে এসেছে। তাই বাসিন্দাদের স্বপ্ন ছিল নানা সমস্যা দূর করতে পারবে পুরসভা। কিন্তু এলাকার কাউন্সিলার ভেঙ্কট রামনা বলেন, “অনেক লড়াই করে এলাকায় পানীয় জলের পাইপ লাইন বসিয়েছি। রেল সব কাজে বাধা দেয়। আমি চাই এলাকার উন্নয়ন হোক। কিন্তু রেল নিজেও করছে না, আমাদেরও করতে দিচ্ছে না।” একই সুরে খড়্গপুরের পুরপ্রধান রবিশঙ্কর পাণ্ডের বক্তব্য, “রেল এলাকায় নিকাশি, পথবাতি, নির্মল শৌচালয়-সহ যাবতীয় পুর পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে। আমি নিজেও রেলের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু লাভ হয়নি। এ বার তাই আমরা রাজনৈতিক ও আইনি লড়াই শুরু করব।” যদিও খড়্গপুরের ডিআরএম গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্বাস, “রেলের কোয়ার্টার যদি খুব বেহাল হয়, তবে আমরা পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ভেঙে দিই। পরিবারগুলিকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক কোয়ার্টার ফাঁকা আছে। তাই অসুবিধা হবে না। ওই এলাকার বিষয়টি আমার নজরে নেই। আমি খোঁজ নেব।”

kharagpur debmalya bagchi rail housing pollution
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy