Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নির্যাতিতা আত্মঘাতী, ধৃত ফব নেতা

সালিশি সভা ডেকে মাতব্বরি আর তার জেরে আত্মহত্যার ঘটনায় আবারও নাম জড়াল এক রাজনৈতিক নেতার। পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরের ওই ঘটনায় গ্রেফতারও হয়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সহ-সভাপতি অশ্বিনী সিংহ। অভিযোগ, বিবাহিত যুবকের সঙ্গে গ্রামেরই যুবতী বধূর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের টানাপড়েন মেটাতে সালিশি ডাকেন অশ্বিনীবাবু। পূর্ব মেদিনীপুরে বামেরা এমনিতেই কোণঠাসা। তার উপরে এই অভিযোগে আরও বিপাকে পড়েছে বাম শিবির।

আনন্দ মণ্ডল
তমলুক শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:০৩
Share: Save:

সালিশি সভা ডেকে মাতব্বরি আর তার জেরে আত্মহত্যার ঘটনায় আবারও নাম জড়াল এক রাজনৈতিক নেতার। পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরের ওই ঘটনায় গ্রেফতারও হয়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সহ-সভাপতি অশ্বিনী সিংহ। অভিযোগ, বিবাহিত যুবকের সঙ্গে গ্রামেরই যুবতী বধূর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের টানাপড়েন মেটাতে সালিশি ডাকেন অশ্বিনীবাবু। পূর্ব মেদিনীপুরে বামেরা এমনিতেই কোণঠাসা। তার উপরে এই অভিযোগে আরও বিপাকে পড়েছে বাম শিবির।

গত শুক্রবারের সেই সালিশি সভায় ওই বধূকে জোর করে তুলে এনে কটূক্তি, মারধর ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় বলে অভিযোগ। শনিবার দুপুরে বাড়িতেই কীটনাশক খান ওই যুবতী। তাঁর মৃত্যুর পরে যুবতীর স্বামী অশ্বিনীবাবু-সহ সাত জনের বিরুদ্ধে স্ত্রীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ দায়ের করেন। রাতেই প্রবীণ বাম নেতা অশ্বিনীবাবু এবং আরও দুই গ্রামবাসীকে ধরে পুলিশ। বাকি অভিযুক্তেরা পলাতক। ধৃতদের রবিবার তমলুক আদালতে হাজির করানো হলে ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ হয়।

জেলার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার অমিতভরত রাঠৌর বলেন, “ওই ঘটনায় তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্তে সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক সমস্যায় রাজনৈতিক নেতাদের নাক গলানো এ রাজ্যে নতুন নয়। বাম আমলেও ছোটখাটো নানা পারিবারিক সমস্যায় সালিশি বসানোর ভুরি ভুরি অভিযোগ উঠত। রাজ্যে পালাবদলের পরেও ছবিটা বিশেষ বদলায়নি। গত বছর সেপ্টেম্বরে ধূপগুড়িতে দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে সালিশিতে নিগ্রহ ও মারধরের অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল কাউন্সিলরের স্বামীর বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করে মেয়েটির বাবাও নিগৃহীত হন। পরে রেললাইনে মেলে কিশোরীর দেহ। গত জুনে সালিশি সভায় পড়শিরা চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলায় আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন মুর্শিদাবাদের এক যুবতী। থানায় সালিশির অভিযোগও রয়েছে। কিছু দিন আগেই শ্লীলতাহানির ঘটনার মীমাংসা করতে ইংরেজবাজার থানায় পুলিশেরই এক এএসআই সালিশি বসান বলে অভিযোগ। তবে সালিশিতে বাম নেতা গ্রেফতারের নজির সাম্প্রতিক অতীতে নেই।

চণ্ডীপুরের ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে সেই বৃন্দাবনপুর ২ পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় রয়েছে সিপিএম। বছর পঁয়ত্রিশের মৃত যুবতী ওই পঞ্চায়েতের নরগ্রামের বাসিন্দা। তাঁর স্বামী গ্রামেরই এক ইটভাটার শ্রমিক। অভিযোগ, ওই ইটভাটারই আর এক কর্মী গৌর মাইতির সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল যুবতীর। গৌরের বাড়িও নরগ্রামেই। এমন সম্পর্কের কথা অবশ্য মানছেন না মৃতার স্বামী। তাঁর বক্তব্য, “গৌরের সঙ্গে স্ত্রী কথা বলত। বন্ধু হিসেবে আমাদের দুই বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল। তবে ওদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল না।” স্থানীয় শক্তিপদ পাত্র ও রমেশ দাসরাও বলেন, “এক জায়গায় কাজের সূত্রে গৌর ওই মহিলার বাড়িতে যেত বলে জানি। সম্পর্কের কথা জানা নেই।”

তবে স্থানীয় সূত্রে খবর, ওই সম্পর্কের অভিযোগ তুলেই গৌরের স্ত্রী দুর্গারানি মাইতি-সহ কয়েক জন গ্রামবাসী অশ্বিনীবাবুর দ্বারস্থ হন। শুক্রবার বসে সালিশি। মৃতার স্বামীর অভিযোগ, শুক্রবার রাতে স্ত্রী বাজার থেকে ফেরার পরে দুর্গারানি, পারুল সামন্ত-সহ স্থানীয় আট-দশ জন স্ত্রীকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর কথায়, “অশ্বিনীবাবুর নেতৃত্বে সালিশি চলছে খবর পেয়ে পরিজনদের নিয়ে আমিও যাই। সভায় গ্রামের জনা চল্লিশেক পুরুষ-মহিলা ছিল।”

স্থানীয় সূত্রে খবর, প্রথমে ওই যুবতীকে এক লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়। পরে তা কমিয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়। টাকা না দিতে পারলে চুল কেটে গ্রামে ঘোরানোর ফতোয়াও দেওয়া হয়। অভিযোগ, মারধর করা হয় গৌরকেও। তবে তাঁকে জরিমানা বা ফতোয়া দেওয়া হয়নি। মৃতার স্বামীর দাবি, “সিপিএমের স্থানীয় মহিলা পঞ্চায়েত সদস্যার বাড়ি গিয়ে সব জানাই। তবে তিনি সালিশিতে আসতে চাননি। পরে গ্রামের এক ভিলেজ পুলিশ বিষয়টি জেনে আমার স্ত্রী ও গৌরকে উদ্ধার করে চণ্ডীপুর থানায় নিয়ে যান।” শুক্রবার রাতেই চণ্ডীপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে ওই যুবতীর চিকিৎসা করানো হয়। ওই যুবতীর স্বামীর অভিযোগ, “স্ত্রীর সঙ্গে আমিও থানায় যাই। কিন্তু পুলিশ ওই রাতে অভিযোগ নেয়নি। শনিবার সকালে লিখিত অভিযোগ করতে বলে।” পুলিশের অবশ্য দাবি, মৃতার স্বামী লিখিত অভিযোগ জানাননি।

এরপর শনিবার দুপুরে কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হন ওই যুবতী। ওই দিনই অশ্বিনীবাবু, গৌর, তাঁর স্ত্রী দুর্গারানি-সহ সাত জনের নামে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন মৃতার স্বামী। তাঁর দাবি, “সুইসাইড নোটে মৃত্যুর জন্য ছ’জন দায়ী বলে লিখে গিয়েছে স্ত্রী। সেই চিরকুট পুলিশকে দিয়েছি।” চিরকুটে অবশ্য অশ্বিনীবাবুর নাম নেই। তাহলে কেন ফব নেতার নামে অভিযোগ করলেন? মৃতার স্বামীর যুক্তি, “অশ্বিনীবাবুই সালিশি সভা ডেকেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই গোটা ঘটনাটি ঘটে। তাই অভিযোগ করি।”

পূর্ব মেদিনীপুরে বামেদের অবস্থা এমনিতেই কোণঠাসা। তার উপর এমন ঘটনায় ফ্রন্টের শরিক দলের জেলা নেতা গ্রেফতার হওয়ায় বাম শিবির অস্বস্তিতে। এলাকার সিপিএম প্রধান শঙ্কর দাস বলেন, “এ ধরনের সালিশি সভা কাম্য নয়।” ফব-র জেলা সম্পাদক গোপাল মাইতিরও বক্তব্য, “এমন ঘটনা এড়িয়ে যাওয়াই উচিত ছিল। তবে ওই সালিশিতে নেতা নয়, গ্রামের বাসিন্দা হিসেবেই হয়তো উনি গিয়েছিলেন।”

ফব-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য জানান, গোটা ঘটনায় তাঁরা দু’ধরনের বক্তব্য পেয়েছেন। এক পক্ষের বক্তব্য, অশ্বিনীবাবু ঘটনায় জড়িত। অন্য মত হল, সমস্যা সমাধানে তাঁর কাছে যাওয়া হয়েছিল। এর বেশি তিনি কিছু করেননি।

‘ঘটনার কথা জানা নেই’ বলে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন জেলার তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী এবং চণ্ডীপুরের দলীয় বিধায়ক অমিয় ভট্টাচার্য। তবে তৃণমূলের চণ্ডীপুর ব্লক সভাপতি অশ্বিনী দাসের বক্তব্য, “গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা মেটাতে আমরাও দু’পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসি। কিন্তু ওই ফব নেতা যা করেছেন, তা মানা যায় না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE