Advertisement
E-Paper

পার্ক একটি, খড়্গপুরে খেলার মাঠ ভরছে আগাছায়

বিকেল বেলা স্কুল শেষে ব্যাগ ফেলে খেলার মাঠে দৌড়। ভরা মাঠে সমস্বরে বলে ওঠা ‘গোওওল’। হারিয়ে যাচ্ছে সেই উন্মাদনা। পিঠে বইয়ের বোঝা শৈশবের আনন্দকে ফিকে করেছে। খড়্গপুরের যেসব মাঠ এক দিন দিকপাল ক্রীড়াবিদদের আতুঁরঘর ছিল, সেখানেই রাতের অন্ধকারে বড় ঘাসের ঝোপঝাড়ে বসছে মদের আসর। নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে রেলশহরের ঐতিহ্যবাহী ময়দানগুলির সোনালি পরিবেশ।

দেবমাল্য বাগচি

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৪ ০১:৫০
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের চাপ স্পষ্ট বিএনআর মাঠে। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের চাপ স্পষ্ট বিএনআর মাঠে। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ

বিকেল বেলা স্কুল শেষে ব্যাগ ফেলে খেলার মাঠে দৌড়।

ভরা মাঠে সমস্বরে বলে ওঠা ‘গোওওল’।

হারিয়ে যাচ্ছে সেই উন্মাদনা। পিঠে বইয়ের বোঝা শৈশবের আনন্দকে ফিকে করেছে। খড়্গপুরের যেসব মাঠ এক দিন দিকপাল ক্রীড়াবিদদের আতুঁরঘর ছিল, সেখানেই রাতের অন্ধকারে বড় ঘাসের ঝোপঝাড়ে বসছে মদের আসর। নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে রেলশহরের ঐতিহ্যবাহী ময়দানগুলির সোনালি পরিবেশ। একসময় খড়্গপুরের বিভিন্ন মাঠ থেকেই উঠে এসেছেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের বর্তমান অধিনায়ক মহেন্দ্রসিংহ ধোনি, ইস্টবেঙ্গলের প্রয়াত ফুটবলার সীতেশ দাস, প্রীতি ঘোষাল, প্রণব বসুদের মতো ক্রীড়াবিদ। খেলাধুলোর চর্চা নয়, পাড়ায় পাড়ায় ‘খেপ’ খেলে টাকা রোজগারই এখন নবীন প্রজন্মের নয়া ট্রেন্ড।

খালসা স্পোর্টস, অন্ধ্র স্পোর্টস, মহামেডান স্পোর্টসের কথা এখন শুধু প্রবীণদের আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ। পঞ্চাশের দশকে রেলশহরের উত্তরদিকের ‘ইউরোপীয়ান রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ড’ (বাইটন ময়দান) ও দক্ষিণ দিকের ‘ইন্ডিয়ান রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ড’ (বিএনআর ময়দান) দাপিয়ে বেড়াত। স্বাধীনতার আগে বাটা গেট পেরিয়ে উত্তরের বাইটন ময়দানে যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। তখন ভারতীয়দের নানা আউটডোর খেলাধুলোর আসর বসত বিএনআর ময়দানেই। আর বিভিন্ন ইন্ডোর গেম’এর আসর বসত নর্থ ইনস্টিটিউটে (রবীন্দ্র ইনস্টিটিউট)। পরে ট্রাফিক রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ড, নিউ সেটলমেন্ট ময়দান, নিমপুরা ময়দানের মতো বহু খেলার মাঠ গড়ে ওঠে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পঞ্চাশের দশকে ম্যাক ফার্নেল সাহেবের মতো বেশ কয়েকজন ইংরেজ আধিকারিকের প্রচেষ্টায় বাইটন গ্রাউন্ডের পাশেই গড়ে তোলা হয় ‘সেরসা’ স্টেডিয়াম, যা আজও রেলশহরের খেলাধুলোর মানচিত্রে উজ্জ্বল নাম।

আগে বিএনআর ময়দানেই রেলের বিভিন্ন বিভাগীয় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। তবে সেরসা স্টেডিয়াম গড়ে ওঠার পর থেকে সেখানেই প্রতিযোগিতাগুলি আয়োজন হত। শুধু বড় ক্লাব নয়, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে খড়্গপুরের মালঞ্চের তরুণ সঙ্ঘ, রেল এলাকার ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ক্লাব’, হিজলীর ‘তরুণ সঙ্ঘ’, সুভাষপল্লির ‘নেতাজি সঙ্ঘ’, ‘শক্তি মন্দির’, ইন্দার ‘ইঙ্গিত’, ‘সবুজ ‘সঙ্ঘ’-এর মতো ক্লাবের খ্যাতি ছিল যথেষ্ট। তবে এখন এই ক্লাবগুলির অধিকাংশই বন্ধ। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিএনআর ময়দানও পরিণত হয়েছে আস্তাকুঁড়ে। একসময়ের দক্ষিণ-পূর্ব রেলের আম্পায়ার প্রবীণ মিন্টু চৌধুরী কিছুটা বিরক্তির সুরেই বলছিলেন, “আমাদের যুগে খেলার মাঠের অভাব ছিল না। রেলের পক্ষ থেকে সমস্ত মাঠ রক্ষণাবেক্ষণ করা হত। আর এখন এক শ্রেণির রেল আধিকারিক ও পুরসভার অনীহায় মাঠের পরিকাঠামোর অভাবে ছেলেপুলেদের খেলাধুলো করতে দেখি না। ক্লাবগুলিতে শুধু তাসের আড্ডা চলছে দেখে কষ্ট হয়।”

২০০১ সালে ‘স্পোর্টস’ কোটায় রেলে চাকরি পেয়ে শহরের বিভিন্ন ময়দানে খেলে গিয়েছেন বর্তমান ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। ধোনির সঙ্গে ঝাড়খণ্ডে রঞ্জি খেলে আসা খড়্গপুরের টিকিট পরীক্ষক দীপক সিংহের মতে, “বছর বারো আগেও খড়্গপুরে যে খুব খেলার প্রসার দেখেছি তা নয়, তবে তখন সব মাঠেই খেলাধুলো হত।” তাঁর দাবি, ঝাড়খণ্ডে খেলার পরিবেশ এখানকার তুলনায় অনেক ভাল। এখানে প্রতিভা আছে, কিন্তু খেলার উপযুক্ত পরিবেশ নেই।

বাণিজ্যের নয়া মোড়কে খেলাধুলো এখন আর সবার জন্য নয়। বিকেল হলেই কাঁধে ব্যাট নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সেই দৃশ্য এখন বিরল। খেলাধুলোর সেই উন্মাদনার স্থানে এখন বড় বড় প্রতিযোগিতা জিতে অর্থ রোজগার করাই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। এক সময় যে বাইটন গ্রাউন্ডে কোনও টিকিট ছাড়াই ঢোকা যেত, সেখানেই এখন টাকা দিয়ে ঢুকতে হয়। আর যাদের সেই সামর্থ্য নেই, তাদের বেহাল বিএনআর ময়দানেই খেলাধুলোর শখ মেটাতে হয়। আর এখন ‘বিরল’ ক্রীড়াপ্রেমীদের উৎসাহ দিতে বাঁশের খুঁটিতে ফ্লাড লাইট লাগিয়ে চালু হয়েছে গ্রিন আকাদেমীর ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। গ্রিন আকাদেমীর সম্পাদক খোকন সরকারের কথায়, “মাঠগুলির দিকে রেল নজর দেয় না। আর শহরের রেল এলাকা পুরসভার অধীনে এলেও পুরসভারও তেমন উদ্যোগ নেই। এতেই উৎসাহ কমছে পাড়ার খেলোয়াড়দের। তাই তাঁদের উৎসাহ বাড়াতেই আমাদের এই প্রয়াস।”

রেলশহরে ছোটদের পার্কেরও করুণ দশা। শহরে বড় পার্ক বলতে রেলের বিএনআর গার্ডেন ও বন দফতরের অধীনে থাকা মবল শহক থেকে অনেক দূরে প্রেমবাজারে ইকো-পার্ক। খড়্গপুর শবরের ৩৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে শুধুমাত্র ১১ নম্বর ওয়ার্ডে একটিমাত্র উদ্যান রয়েছে। তবে তারও অবস্থা বেহাল। খড়্গপুর পুরসভার পুরপ্রধান রবিশঙ্কর পাণ্ডে বলেন, “জমির অভাবে আমরা উদ্যান করতে পারছি না। আর রেলের ময়দান পরিচ্ছন্ন রাকা আমাদের অক্তিয়ারে পড়ে না।” রেলের মাঠগুলির সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রশ্নে খড়্গপুরের ডিআরএম গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রেলের যে অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, তা রাস্তা ও রেলের যাত্রী পরিষেবার কাঠামো গড়তেই চলে যাচ্ছে। তাই মাঠগুলির রক্ষণাবেক্ষণে আমরা নজর দিতে পারছি না। এ বার নিশ্চয়ই বিষয়টি দেখব।”

amar shohor debmalya bagchi kharagpur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy