Advertisement
E-Paper

‘সারেন্ডার’ করুক মেয়ে, চান লুলকি মাহাতো

মেয়ের নাম জবা। মাটির বাড়ির উঠোনে জবা ফুলের গাছ লাগিয়েছেন লুলকি মাহাতো। তাতে ধরেছে থোকা থোকা সাদা জবাফুল। অনেক বছর মেয়ের দেখা পাননি, তাই উঠোনের সাদাজবার দিকে তাকিয়েই দিনের অনেকটা সময় কেটে যায় ষাটোর্ধ্ব বিধবা।

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৪ ০১:২৫
ভোটের প্রচার নেই। ফাঁকা পড়ে রয়েছে জামিরডিহা গ্রামের দেওয়াল। সেখানে এখনও মেয়ের জন্য পথ চেয়ে রয়েছেন মাও-নেত্রী জবা মাহাতোর মা। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।

ভোটের প্রচার নেই। ফাঁকা পড়ে রয়েছে জামিরডিহা গ্রামের দেওয়াল। সেখানে এখনও মেয়ের জন্য পথ চেয়ে রয়েছেন মাও-নেত্রী জবা মাহাতোর মা। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।

মেয়ের নাম জবা। মাটির বাড়ির উঠোনে জবা ফুলের গাছ লাগিয়েছেন লুলকি মাহাতো। তাতে ধরেছে থোকা থোকা সাদা জবাফুল। অনেক বছর মেয়ের দেখা পাননি, তাই উঠোনের সাদাজবার দিকে তাকিয়েই দিনের অনেকটা সময় কেটে যায় ষাটোর্ধ্ব বিধবা।

মাওবাদীদের এক সময়ের ধাত্রীভূমি বেলপাহড়ির জামিরডিহা গ্রামটি ভোট প্রচারের বাইরেই থেকে গিয়েছে। লুলকিদেবীর মেয়ে যে ‘ফেরার’ মাওবাদী স্কোয়াড-নেত্রী জবা মাহাতো! পুলিশ সূত্রের দাবি, ‘ফেরার’ মাওবাদী নেতা মদন মাহাতোর স্ত্রী হলেন জবা। তবে মদন-জবাব সম্পর্কের কথা স্বীকার করতে চান না লুলকিদেবী। তাঁর কথায়, “এক সময় অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা ছিল। বছর দশেক আগে হঠাৎই একদিন ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল মেয়ে। কেন গিয়েছিল তখন বুঝিনি। অনেকে বলে, জবা নাকি মদনকে বিয়ে করেছে। আমি কিন্তু মেয়ের বিয়ে দিইনি!”

২০০৯-১০ সালে মাওবাদী-জনগণের কমিটির আন্দোলন পর্বে তখন উত্তাল জঙ্গলমহল। সেই সময় এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াত সশস্ত্র মাওবাদীরা। বছর চারেক আগে শেষবার মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল লুলকিদেবীর। মেয়ের কথা বলতে বলতে চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে মায়ের। লুলকিদেবী জানালেন, মেয়ে মাওবাদী সংগঠনে নাম লেখানোয় গোটা পরিবারটিকেই সন্দেহের চোখে দেখে পুলিশ। কয়েক বছর আগে জবার ভাই বিশ্বনাথকেও মাওবাদী সন্দেহে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে জেল খাটতে হয়েছে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে বিশ্বনাথ এখন গ্রামে থাকেন না, ঝাড়গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। জামিরডিহা গ্রামের বাড়িতে একাই থাকেন বিধবা লুলকিদেবী। সামান্য জমিজিরেত আর বাবুই ঘাসের দড়ি বিক্রি করে সংসার চলে যায়।

এত দিন ভোট নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চাইতেন না জামিরডিহার বাসিন্দারা। লুলকিদেবীও অন্তরালে থাকতেন। আর এখন লুলকিদেবী চাইছেন, মেয়ে মূলস্রোতে ফিরে নতুন করে জীবন শুরু করুক। তাঁর কথায়, “সুচিত্রা, জাগরীর মতো অনেকেই আত্মসমর্পণ করে ভাল আছে শুনেছি। মেয়েটা কোথায় কী ভাবে আছে জানি না। দেখা হলে বলতাম, সারেন্ডার করে বাঁচার মতো বাঁচতে।”

শান্তির জঙ্গলমহলে মাওবাদী প্রভাবিত এলাকাগুলিতেও ভোটের প্রচারে যাচ্ছেন শাসক ও বিরোধী দলের কর্মীরা। কিন্তু লক্ষ্যণীয় ভাবে জামিরডিহা গ্রামে সার সার মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলি ফাঁকা। লোকসভা ভোটের পক্ষকাল আগেও ভোটের কোনও প্রচার নেই এলাকায়। কেউ প্রচারে আসেনি? মাথা নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে মাটিতে আঁক কাটতে কাটতে লুলকিদেবীর জবাব, “ভোটের প্রচারে এ গ্রামে তো কেউই আগে আসত না। এ বারও সে ভাবে এখনও কেউ আসেনি। সিপিএমের লোকেরা একদিন এসেছিল। আমি তো ভোট দিই। এ বারও দেব।” জামিরডিহার বাসিন্দা ভীম মাহাতো, কল্পনা মাহাতোরা বলেন, “ভোট নিয়ে আর কী ভাবব? ভোটের দিন দেখা যাবে।”

গত তিন বছরে এলাকার ৪৮ সিপিএম কর্মী-সমর্থক মাওবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন। যার কয়েক’টিতে অভিযুক্ত মদন-জবা। মাও-সন্ত্রাসের পাল্টা সিপিএমের সন্ত্রাসেরও অভিযোগ উঠেছিল এক সময়। রাজ্যে পালাবদলের পরে পরিস্থিতি বদলেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামিরডিহার আশেপাশের গ্রামগুলিতে সিপিএম ও তৃণমূলের কয়েক’টি দেওয়াল লিখন চোখে পড়ছে। কিন্তু প্রচারে নেই জামিরডিহা।

পাশের গ্রাম রামপুরে শুধু সিপিএম দেওয়াল লিখেছে। রামপুর গ্রামের স্থানীয় সিপিএম কর্মী জগন্নাথ মাহাতোরা বাড়ি-বাড়ি প্রচারে যাচ্ছেন। জামিরডিহা ও পাশাপাশি, কাশমাড়, মাহাতো বাঁধের মতো একাধিক গ্রামে ভোটের দেওয়াল লিখন চোখে পড়ল না।

তবে এলাকায় সে ভাবে তৃণমূলেরও প্রচার নেই বললেই চলে। সিপিএমের বেলপাহাড়ি জোনাল কমিটির সম্পাদক উদ্ধব মাহাতোর দাবি, “এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। রাজ্যে তৃণমূলের সরকারের আড়াই বছরের শাসনে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছেন। যে সব এলাকায় আগে আমরা কার্যত ঢুকতে পারতাম না, সেখানে এখন দলীয় কর্মীরা প্রচার করছেন।” জামিরডিহায় প্রচার নেই কেন? তৃণমূলের বেলপাহাড়ি ব্লক সভাপতি বনপতি মাহাতোর ইতস্তত জবাব, “ওই সব এলাকায় দেওয়াল লিখন শুরু করতে একটু দেরি হয়েছে ঠিকই। তবে আমরা নির্বাচনী দেওয়াল লিখনের পাশাপাশি, পোস্টারও সাঁটাব। এলাকায় সিপিএমের পায়ের তলায় কোনও মাটি নেই। ওরা পুরনো বন্ধু মাওবাদীদের হাত ধরে গোলমাল পাকানোর ছক কষছে।”

রাজনৈতিক প্রসঙ্গে অবশ্য লুলকিদেবীর নির্লিপ্ত জবাব, “এক সময় একদল পেত, অন্যরা কিছু পেত না। এই জন্যই তো এলাকায় যত অশান্তি ছিল। এখন নতুন সরকার। সবই নতুন। কিন্তু পরিস্থিতির তো কিছু বদল দেখছি না।”

তবু গণতন্ত্রেই আস্থা রাখছেন মাওবাদী নেত্রীর মা। বলছেন, “আশা নিয়েই তো মানুষ বাঁচে!”

kishuk gupta surrender lulki mahato
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy