Advertisement
E-Paper

গণপিটুনির নায়কের খোঁজে হামলা গ্রামে

কোথায় তাপস মল্লিক, খুঁজছে গুমকি গ্রাম। তৃণমূল নেতা তাপসকে হাতের সামনে না পেয়ে তার গ্রামে ঢুকে বুধবার দুপুরে তাণ্ডব চালায় জনা চল্লিশ যুবকের একটি দল। ম্যাটাডর ভাড়া করে হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে হইহই করে তারা ঢুকে পড়ে পশ্চিমপাড়া গ্রামে।

দিলীপ নস্কর

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৬ ০৩:৩৯
মোষ-চোর সন্দেহে গণপ্রহারে নিহত পড়ুয়া কৌশিক পুরকাইতের দেহের পাশে শোকার্ত মাসি ও ঠাকুমা। বুধবার গুমকি গ্রামের বাড়িতে দিলীপ নস্করের তোলা ছবি।

মোষ-চোর সন্দেহে গণপ্রহারে নিহত পড়ুয়া কৌশিক পুরকাইতের দেহের পাশে শোকার্ত মাসি ও ঠাকুমা। বুধবার গুমকি গ্রামের বাড়িতে দিলীপ নস্করের তোলা ছবি।

কোথায় তাপস মল্লিক, খুঁজছে গুমকি গ্রাম।

তৃণমূল নেতা তাপসকে হাতের সামনে না পেয়ে তার গ্রামে ঢুকে বুধবার দুপুরে তাণ্ডব চালায় জনা চল্লিশ যুবকের একটি দল। ম্যাটাডর ভাড়া করে হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে হইহই করে তারা ঢুকে পড়ে পশ্চিমপাড়া গ্রামে। সেখানেই বন্দর এলাকায় তোলাবাজির টাকায় বিশাল প্রাসাদ হাঁকিয়েছে তাপস, অভিযোগ এমনটাই। একের পর এক পাঁচ-ছ’টি বাড়িতে ভাঙচুর করে জনতা। একটি খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার রাত থেকেই গোটা পশ্চিমপাড়া এলাকা কার্যত পুরুষশূন্য। ফলে কোনও প্রতিরোধই ছিল না। বেলাগাম যুবকের দল এক রকম বিনা বাধায় তাণ্ডব চালায়।

তবে তাপসের বাড়ি পৌঁছনোর আগেই খবর পেয়ে ডায়মন্ড হারবার থানার পুলিশ গিয়ে উত্তেজিত জনতাকে সামলায়। ঘটনাস্থল থেকেই গ্রেফতার করা হয় বিকাশ মিস্ত্রি এবং অজিত বণিককে। যে গাড়িতে চড়ে গুমকি গ্রাম থেকে এসেছিল যুবকেরা, সেই গাড়িটি চালাচ্ছিল বিকাশ।

মন্দিরবাজারের গুমকি গ্রামের যুবক আইটিআই পড়ুয়া কৌশিক পুরকাইত ওরফে শুভকে তাপসের নেতৃত্বে পশ্চিমপাড়ার লোকজন মোষ চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরেছে। সোমবার রাতে বাহাদুরপুরের পূর্বপাড়ায় মাসির বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিলেন কৌশিক। রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ নির্জন একটি গাছতলায় বসে ফোনে কথা বলছিলেন নিরীহ ওই যুবক। তখনই পশ্চিমপাড়া থেকে একদল লোক এসে তাঁকে মোষ চোর সন্দেহে ঘিরে ধরে। পেটাতে পেটাতে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের পশ্চিমপাড়ায়, নিজেদের এলাকায়।

মঙ্গলবার শৈলবালা বাগ নামে এক মহিলাকে গণপিটুনির ঘটনায় গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। পরে ধরা পড়ে আরও তিন জন। ধৃতদের নাম শ্যাম হালদার, রাম হালদার ও পান্নালাল মণ্ডল। বুধবার সকলকে ডায়মন্ড হারবার আদালতের বিচারক ১৩ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।

ধৃতদের জেরা করে তদন্ত এগোচ্ছে বলে পুলিশ দাবি করলেও মূল অভিযুক্ত তাপস গ্রেফতার না হওয়ায় ফুঁসছে এলাকা। শাসক দলের লোক হওয়ার জন্যই তাপসকে পুলিশ ধরছে না বলে অভিযোগ তুলছে বিরোধীরা। তবে পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘একজন পঞ্চায়েত সদস্যও যদি বড় নেতা হয়ে যায়, তা হলে তো চাকরি করারই মানে হয় না। নিশ্চয়ই ওকে খুঁজে বের করব।’’ কিন্তু তাপস যতক্ষণ ধরা না পড়ছে, জনরোষ যে কমবে না, এ দিনের ঘটনা তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

স্থানীয় হরিণডাঙা পঞ্চায়েতের সদস্য তথা তৃণমূল নেতা তাপস মল্লিকই গণপিটুনির ইন্ধন দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। এমনকী, ওই নেতা নিজেও মারধরে হাত লাগান। টর্চের বাড়ি মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয় কৌশিকের। সেই সঙ্গে চলে চড়-থাপ্পড়, লাথি-ঘুষি। সামনে তখন হাজির কৌশিকের মা-মাসিরাও। মারধর করা হয় তাঁদেরও। অভিযোগ, ছেলের প্রাণের বিনিময়ে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা দিতে হবে বলে সাদা কাগজে লিখিয়ে নেওয়া হয় কৌশিকের মা চন্দ্রাদেবীকে দিয়ে। কিন্তু সেই কাগজ হাতে যতক্ষণে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছেন তাঁরা, ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। বাঁচানো যায়নি কৌশিক ওরফে শুভকে।

এ দিকে, ময়না-তদন্তের পরে এ দিন বেলা আড়াইটে নাগাদ কৌশিকের দেহ শববাহী গাড়িতে করে আনা হয় পূর্বপাড়ায়। সেখানে ছিলেন সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়-সহ দলের নেতারা। কৌশিকের মাসি ছন্দা হালদার বলেন, ‘‘আমাদের সোনার টুকরো ছেলেটাকে ওরা চোখের সামনে পিটিয়ে মেরে ফেলল। এর বিহিত চাই।’’ কান্তিবাবু জানান, দোষীরা যাতে কঠোর শাস্তি পায়, সে দিকে দেখবেন। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘নিহত যুবকের হত্যাকারীদের কেন এখনও গ্রেফতার করা হল না! অভিযুক্ত ব্যক্তির তৃণমূল পরিচয়ই কি রক্ষাকবচের কাজ করছে?’’ সিপিএমকে নিহতের পরিবারটির পাশে দেখা গেলেও ডায়মন্ড হারবারের বিদায়ী বিধায়ক দীপক হালদার অবশ্য এলাকায় আসেননি। ঘটনায় মূল অভিযুক্ত তাপস মল্লিক দীপকবাবুর ঘনিষ্ঠ বলেই শোনা যাচ্ছে। কেন গেলেন না এলাকায়? দীপকবাবুর সাফাই, ‘‘পরিবারটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। ওঁদের পাশে আছি। কিন্তু সিপিএম এ নিয়ে নোংরা রাজনীতি শুরু করেছে। তা-ই আপাতত এলাকায় যাচ্ছি না।’’

এ দিন কান্তিবাবুরা যখন পূর্বপাড়ায়, তখনই সেখানে গুমকি থেকে ৩০-৪০ জন যুবকের দলটি হাজির হয়। কৌশিককে খুনের বদলা নিতে তৈরি তারা। কান্তিবাবু সকলের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। পরে শবদেহ নিয়ে তাঁরা রওনা দেন গুমকির দিকে। পথেই পড়ে পশ্চিমপাড়া। ওই ছেলের দল মাঝপথ থেকে অন্য রাস্তা ধরে ঢুকে পড়ে সেখানে। তার পরেই শুরু হয় তাণ্ডব।এ দিকে, পূর্বপাড়া থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে গুমকি গ্রামে শবদেহ পৌঁছনোর পথের দু’ধারে মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। বহু জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিতে হয়। ফুল-মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন মহিলা-পুরুষের দল। কান্তা পুরকাইত, রমা পুরকাইতরা কৌশিকের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। তাঁরা বলেন, ‘‘এমন নিরীহ একটা ছেলে। সকলের সঙ্গে হেসে কথা বলত। ছোট থেকে ঝগড়া-মারামারি করেছে বলেও শুনিনি।’’

বুধবার পশ্চিমপাড়ায় গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা গেল কয়েকজন মহিলার সঙ্গে। রাত থেকে বার কয়েক পুলিশ এসে ঘুরে গিয়েছে বলে জানালেন তাঁরা। নাম লেখা হবে না, এই শর্তে এক মহিলা বলেন, ‘‘ছেলেটাকে নৃশংস ভাবে মারধর করা হচ্ছিল। সে দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। আমাদের গা শিউরে উঠছিল।’’ কেউ কেউ জানালেন, মহিষ চোর সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে ছেলেটা নাম-ধাম বলেছিল। বলেছিল, পাশের গ্রামে থাকেন মেসো সত্য হালদার। খোঁজ-খবর না করেই শুরু হল মার। কিছু মহিলাও ‘হাতের সুখ’ করে নেন। ঘটনাটা ঘটে তাপসের নেতৃত্বেই।

তাপস আর তার চ্যালা-চামুণ্ডাদের দাপটে পশ্চিমপাড়ার লোকজনও তিতিবিরক্ত বলে জানা গেল। মদ-গাঁজা খেয়ে হুজ্জুত করে তারা। প্রতিবাদ করেও লাভ হয় না। উল্টে বাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল-পাটকেল মারা হয়। রাস্তা দিয়ে যেতে গেলে কটূক্তি করা হয়।

এক মহিলা বললেন, ‘‘বড্ড বাড় বেড়েছিল ওরা। এখন হয় তো অনেক তোলপাড় হবে। ধরপাকড় হবে। কিন্তু গ্রামে কালীপুজোয় মহিষ বলির আগে যে নরবলি হয়ে গেল, সেই রক্তের দাগ মুছবে কী করে!’’

TMC Public
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy