পুজো কমিটিগুলিকে আয়কর দফতরের তলব নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য সঙ্ঘাত চরমে ওঠার ইঙ্গিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার্তায়।
পুজো কমিটিগুলির কাছে আয়কর নোটিস পৌঁছনো ঘিরে চড়তে শুরু করল টানাপড়েনের পারদ। কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি সঙ্ঘাতে যাওয়ার বার্তা দিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বারাসতে যাত্রা উৎসবের উদ্বোধন মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, ‘‘একটা ক্লাবের গায়ে যদি হাত পড়ে, আমরা কেউ কিন্তু ছেড়ে কথা বলব না।’’ আয়কর বিভাগের তলবে সাড়া দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই— ক্লাব তথা পুজো কমিটিগুলিকে শুক্রবার এই বার্তাও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। অন্য দিকে, আরও ৩৫০ ক্লাবকে নোটিস পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন আয়কর কর্তারা।
দূর্গাপুজো কমিটিগুলিকে আয়কর বিভাগ নোটিস দেওয়ার পর থেকেই রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে। পুর ও নগরন্নোয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম সরাসরি কেন্দ্রের দিকে আঙুল তুলেছেন আগেই। এ বার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিশানায় কেন্দ্র। শুক্রবার তিনি বলেন, “আমি সবক’টা ক্লাবকে বলব, একদম যাবেন না।’’
প্রথম দফায় ৪০টি পুজো কমিটিকে নোটিস পাঠিয়েছিল আয়কর দফতর। তার মধ্যে ১০টি ক্লাব ইতিমধ্যেই দফতরের টিডিএস বিভাগের অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেছে। ওই পুজো উদ্যোক্তাদের কাছে পুজোর আয়-ব্যয় সংক্রান্ত কিছু নথি চেয়েছেন দফতরের আধিকারিকরা। বাকি ক্লাব বা পুজো কমিটিগুলি এখনও আয়কর কর্তাদের সামনে হাজিরা দেয়নি। এই পরিস্থিতিতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন পুজো কমিটিগুলোর আয়কর না দেওয়ার পক্ষে জোরদার সওয়াল করলেন এবং আয়কর দফতরের তলবে সাড়া না দেওয়ার পরামর্শ প্রকাশ্যেই দিয়ে দিলেন।
আরও পড়ুন: মঞ্চে ‘লাল সেলাম’ বলে ফেলে জিভ কাটলেন সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়া বিধায়ক, হেসে ফেললেন শুভেন্দু!
তিরুপতি, সিদ্ধি বিনায়ক, তারকেশ্বর, জগন্নাথ মন্দির বা ফুরফুরা শরিফ, অজমেঢ় শরিফ বা স্বর্ণমন্দির কি আয়কর দেবে? প্রশ্ন তোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদি ওই সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আয়কর না দেয়, তা হলে দুর্গাপুজো উদ্যোক্তারা কেন আয়কর দেবেন? মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন অনেকটা এ রকমই। নরেন্দ্র মোদী কি বাংলায় দুর্গাপুজো বন্ধ করার চক্রান্ত করছেন? মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সে প্রশ্নও তোলেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর হুঁশিয়ারি— একটা ক্লাবের গায়ে হাত পড়লে ছেড়ে কথা বলা হবে না।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর এই সব মন্তব্যই প্রমাণ করছে যে, জমা-খরচের হিসেবটা পরিষ্কার নয়। তিনি কিছু লুকোতে চাইছেন। আমি ‘তিনি’ই বলছি, কারণ তাঁর মন্ত্রীরাই কলকাতার সবচেয়ে খরচসাপেক্ষ পুজোগুলোর উদ্যোক্তা।’’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কারও মনে করিয়ে দেওয়া উচিত, দেশে একটা আইন রয়েছে এবং সেটা গোটা ভারতেই প্রযোজ্য। যদি তিনি মনে করেন, তিনি সেই আইনের ঊর্ধ্বে, তা হলে তাঁকে ফলটা ভুগতে হবে।’’
আরও পড়ুন: ‘স্বাভাবিক ন্যায়বিচার হয়নি’, চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে তোপ অপসারিত অলোক বর্মার
রাজ্য বিজেপি-ও মুখ্যমন্ত্রীর এই অবস্থানের বিরোধিতায় মুখ খুলেছে। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলেন, ‘‘বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বোধহয় জানেন না যে, তিরুপতির মন্দিরেও আয়কর দফতরের নোটিস পৌঁছেছে এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে একটা তদন্তও হচ্ছে।’’ বাবুলের সুরে সায়ন্তনও দাবি করেন, দেশের আইন-কানুন না মানার একটা প্রবণতা দেখাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গকে পশ্চিম বাংলাদেশ বানানোর একটা চক্রান্ত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার সব দিকে নজর রাখছে। প্রয়োজন হলে উপযুক্ত পদক্ষেপ কেন্দ্র করবে।’’
রাজ্য যতই সঙ্ঘাতের বার্তা দিক, পুজো কমিটিগুলোর কাছ থেকে হিসাব বুঝে নেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে তাঁরা যে সহজে পিছু হঠবেন না, আয়কর দফতরের গতিবিধিতে তা কিন্তু স্পষ্ট। এ দিন পার্ক স্ট্রিটে আয়কর দফতরে হাজির হয়েছিল কলকাতার বেশ কয়েকটি নামী পুজো কমিটি। প্রথম দিনে তাঁর যথেষ্ট নথি দেখাতে না পারায়, ফের এ দিন তলব করা হয়েছিল। দফতরের এক পদস্থ আধিকারিকের কথায়, “আমরা দু’বছর আগেও একবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তখন পুজোর মুখে বলে বিষয়টি নিয়ে আমরা আর এগোইনি। কিন্তু এ বার হিসেব বুঝিয়ে দিতেই হবে।’’ শুধু ২০১৮ সালের পুজো নয়, এর পর থেকে প্রতি বছরই যে পুজো কমিটিগুলিকে আয়-ব্যয়ের হিসেব আয়কর দফতরে দাখিল করতে হবে, আয়কর কর্তারা তা-ও জানাচ্ছেন। এক কর্তার কথায়, ‘‘যে পুজোগুলো বড় বাজেটের, যাঁরা থিম পুজো করে থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে টিডিএস কেটে শিল্পীদের পারিশ্রমিক দিতে কোনও অসুবিধা তো হওয়ার কথা নয়।”
আয়কর দফতর সূত্রের খবর, উৎসমূলে কর কেটে (টিডিএস) তা আয়কর দফতরের কাছে জমা করার অভ্যাস অধিকাংশ পুজো উদ্যোক্তারই নেই। ফলে পুজোয় কোন খাতে কত টাকা আয়-ব্যয় হয়, তার হিসেব পাওয়া যায় না। আয়কর দফতর যে রিটার্ন দাখিল করতে বলেছে বা বিস্তারিত তথ্য দিতে বলেছে,তা জমা দিতে গেলে এই পুজো কমিটিগুলির কেবলমাত্র প্যান কার্ড থাকলেই হবে না, থাকতে হবে ট্যান কার্ডও, জানাচ্ছেন আয়কর কর্তারা।
তবে আয়কর দফতর যা-ই বলুক, মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছে, ক্লাব বা পুজো কমিটিগুলির কাছ থেকে পুজোর আয়-ব্যয়ের হিসেব আদায় করা বা কর আদায় করা খুব একটা সহজ হবে না। জনগণের দেওয়া চাঁদায় পুজো হয়, কেউ লাভ করার জন্য পুজো করেন না, তা হলে কিসের আয়কর? এ দিন এমন প্রশ্নই তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
(বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া -পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবর আমাদের রাজ্য বিভাগে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy