Advertisement
০২ মে ২০২৪

মুকুলকে নিয়ে দোলাচলে বিজেপি

এ বার কী করবেন মুকুল রায়? জোড়া উপনির্বাচনের দিনে মুকুল ও তাঁর ছেলের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে পরের দিনই একদা তাঁর সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগীর ডানা পুরোপুরি ছেঁটে ফেলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর গত কাল জয়ের খবর আসার পরে তাঁকে যে ভাবে নস্যাৎ করে দিয়েছেন তিনি, তাতে মুকুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নটাই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজধানীর রাজনৈতিক অলিন্দে।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪৪
Share: Save:

এ বার কী করবেন মুকুল রায়?

জোড়া উপনির্বাচনের দিনে মুকুল ও তাঁর ছেলের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে পরের দিনই একদা তাঁর সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগীর ডানা পুরোপুরি ছেঁটে ফেলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর গত কাল জয়ের খবর আসার পরে তাঁকে যে ভাবে নস্যাৎ করে দিয়েছেন তিনি, তাতে মুকুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নটাই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজধানীর রাজনৈতিক অলিন্দে। মুকুল যে তৃণমূলকে খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছেন, সেটাও মোটের উপর স্পষ্ট। মমতা যেমন গত কাল মুকুল নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছেন, ‘আমার ব্লক সভাপতিদের জিজ্ঞাসা করুন’, মুকুলও তেমনই পাল্টা হিসেবে তৃণমূলের জয়কে কোনও গুরুত্বই দিতে চাননি। উল্টে বিজেপির বিপুল ভোটবৃদ্ধিকেই গুরুত্বপূর্ণ বলেছেন।

এ হেন পরিস্থিতিতে জল্পনা আরও উস্কে দিয়ে আজ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে একান্তে এক প্রস্ত আলোচনা করেছেন মুকুল। সংসদীয় পরামর্শদাতা কমিটির বৈঠক উপলক্ষে দু’জনের দেখা হয়। মুকুল ওই কমিটির সদস্য। মুকুল-রাজনাথ বৈঠকের পরে রাজধানীর রাজনীতিকদের প্রশ্ন, তবে কি বিজেপিতে যোগ দিতে চলেছেন তৃণমূলের দু’নম্বর? মুকুল নিজে অবশ্য এমন জল্পনা উড়িয়ে দিচ্ছেন। অন্তত প্রকাশ্যে। আজ তিনি বলেন, “আমি তৃণমূলের এক জন সক্রিয় কর্মী। এখনও পর্যন্ত দল যা দায়িত্ব দিয়েছে, আমি তা পালন করে চলেছি।”

বিজেপি সূত্র বলছে, মুকুলকে সরাসরি দলে নেওয়ার ব্যাপারে দলীয় নেতাদের মধ্যে একটা দোলাচল রয়েছে। এক অংশের নেতাদের বক্তব্য, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনীতি যদি করতেই হয়, তা হলে মুকুলকে দলে নেওয়াটাই সব চেয়ে ভাল। তাতে সাংগঠনিক দিক থেকেও বিজেপি লাভবান হবে। ওই নেতাদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পক্ষে ভাল হাওয়া থাকলেও তাকে ভোটবাক্সে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো দক্ষ সংগঠক যে নেই, সেটা গত কালের উপনির্বাচনের ফল থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। রাজ্যের অনেক বিজেপি নেতা নিউজ চ্যানেলে বিবৃতি দিতে যতটা আগ্রহী, গ্রামাঞ্চলে সংগঠন বিস্তার করতে, স্থানীয় বিষয় নিয়ে মাঠে নামতে ততটা নন। অন্য দিকে, তৃণমূলের সংগঠনের বেশির ভাগটাই মুকুলের নিজের হাতে গড়া। একটা সময় মমতার জনপ্রিয়তাও ভোটবাক্স পর্যন্ত আসত না। মুকুল ধীরে ধীরে সেই অবস্থা পাল্টে দেন। মুকুলকে দলে নিলে রাজ্যে বিজেপির সংগঠন চাঙ্গা করে ফেলে ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে তৃণমূলকে বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া যাবে বলে কেন্দ্রের ওই বিজেপি নেতাদের ধারণা।

এর বিপরীতে বিজেপির অন্য নেতাদের বক্তব্য, সারদা কেলেঙ্কারিতে অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে মুকুলের নাম উঠে এসেছে। সিবিআই ইতিমধ্যেই তাঁকে এক বার ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রের খবর, সেই জিজ্ঞাসাবাদ থেকে সমস্ত প্রশ্নের জবাব মেলেনি। ফলে মুকুলকে আরও অন্তত দু’বার তলব করতে চায় তারা। এই পরিস্থিতিতে মুকুলকে দলে নিলে তৃণমূলের যে দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে রাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, তার ধার অনেকটাই ভোঁতা হয়ে যাবে বলে বিজেপির একাংশের ধারণা। রাজ্য বিজেপির ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ কলকাতায় গিয়ে বলে এসেছিলেন, “২০১৪-এ ভাগ মদন ভাগ, ২০১৫-এ ভাগ মুকুল ভাগ। আর ২০১৬-এ ভাগ মমতা ভাগ।” এর পরেই গত বছরের শেষে মদন মিত্রকে গ্রেফতার করে সিবিআই। সম্প্রতি ডেকে পাঠানো হয় মুকুলকে। এই ঘটনাকে সামনে রেখে বনগাঁ ও কৃষ্ণগঞ্জের উপনির্বাচনে প্রচার করেছে বিজেপি। ভোটের বাক্সে তার ফলও মিলেছে। মুকুলকে দলে নেওয়াটা সেই অগ্রগতিতে জল ঢেলে দিতে পারে বলে ওই বিজেপি নেতাদের মত। তা ছাড়া, এ ক্ষেত্রে কৌশলের থেকে নীতির প্রশ্নটাকেই বড় করে দেখতে চান তাঁরা।

সিদ্ধার্থনাথ নিজেও মুকুলকে এখনই দলে নেওয়ার পক্ষপাতী নন বলে বিজেপি সূত্রে খবর। তাঁর মতে, সিবিআই মুকুল সম্পর্কে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্তে না পৌঁছনো পর্যন্ত আগ বাড়িয়ে কিছু করা উচিত নয়। মুকুলের ব্যাপারে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে সিদ্ধার্থনাথের কথা হয়েছে বলেও খবর। সিদ্ধার্থনাথ নিজে অবশ্য মুকুলকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনও আলোচনাতেই যেতে নারাজ। আজ এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করে হলে তাঁর মন্তব্য, “অন্য কোনও সিরিয়াস প্রশ্ন করুন, জবাব দেব।”

কিন্তু সিবিআই যখন মুকুলকে জেরা করে, তার পরে রাজ্য বিজেপি সভাপতি রাহুল সিংহ বলেছিলেন মুকুল রায় রাজসাক্ষী হতে পারেন। সেই মন্তব্য থেকে অনেকেই মনে করেছিলেন, মুকুলের জন্য দরজা খুলে রাখছে বিজেপি। রাজ্যে বিজেপির মুখপাত্র শিশির বাজোরিয়া অবশ্য এ দিন দাবি করেছেন, “এটা রাহুলের নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। বিজেপি কোনও ভাবেই তৃণমূলকে ভাঙতে চায় না। কিন্তু যদি তৃণমূলে ভাঙনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা হলে তা রোখার দায়িত্ব তো আমাদের নয়। তৃণমূল থেকে কেউ যদি আমাদের দলে যোগ দিতে চান, তা হলে তাঁর সব দিক খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

বিজেপি সূত্র বলছে, অন্য নেতারা যে যা-ই বলুন, মুকুলের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ এবং অরুণ জেটলি। এঁদের কারও সঙ্গেই মুকুলের এখনও পর্যন্ত কোনও বৈঠক হয়নি। তবে তিনি বিজেপি এবং আরএসএসের কিছু নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলছেন বলে জানা গিয়েছে। ওই নেতাদের একটি অংশের তরফে মুকুলকে একটি মঞ্চ গড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যে মঞ্চে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতারা যোগ দিতে পারবেন। বিজেপি সেই মঞ্চের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ রেখে চলবে। এইপ্রস্তাব সম্পর্কে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেননি মুকুল।

দিল্লিতে বসে মুকুল কী করছেন, সে দিকে কড়া নজর রাখছেন মমতাও। মুকুলের সম্ভাব্য পদক্ষেপ আন্দাজ করে চলছে পাল্টা কৌশল তৈরির কাজও। দলে মুকুল-জমানা শেষ করে অভিষেক-যুগ যে শুরু হয়ে গিয়েছে, তা রাখঢাক না রেখেই বলে দিচ্ছেন তৃণমূল নেতারা। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন কলকাতায় বলেছেন, “অতীতেও দল ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু যাঁরা এ কাজ করেছেন, মানুষ তাঁদের প্রত্যাখ্যান করেছে।” উপলক্ষ দলত্যাগী মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর হলেও এই মন্তব্যের আসল লক্ষ্য মুকুল বলেই দলের অনেকের ধারণা। এই পরিস্থিতিতে আগামী পরশু কলকাতা ফিরছেন মুকুল রায়। ঘটনাচক্রে সে সময়ে বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছেন মমতা। তিনি ফিরে আসার আগেই দিল্লি চলে আসবেন মুকুল। কালীঘাটের বৈঠকে না যাওয়ার পর নেত্রীকে এ ভাবে এড়িয়ে যাওয়াকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।

মুকুল কাঁটার পাশাপাশি আজ ফের তৃণমূলকে নতুন করে অস্বস্তিতে ফেলেছেন সদ্য সহ সভাপতিরপদে বসা দীনেশ ত্রিবেদী। একটি ইংরেজি দৈনিকে ফের মোদীর প্রশংসা করেছেন তিনি। সূত্রের খবর, দলের আরও বেশ কিছু সাংসদ ও নেতা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে।

বস্তুত, মুকুলের মতো অনিশ্চয়তায় তৃণমূল শিবিরও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE