Advertisement
০৪ মে ২০২৪
কেন হল, প্রশ্ন রেলের অন্দরেই

কনস্টেবলের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু

মাতৃভূমি লোকাল থেকে পড়ে যাত্রী-মৃত্যুর ঘটনায় রেলরক্ষী বাহিনীর (আরপিএফ) মহিলা কনস্টেবলের বিরুদ্ধে খুনের মামলা শুরু করল রেল পুলিশ। কিন্তু সেই সঙ্গে সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে চললে এমনটা যে ঘটত না, সেটাও কিন্তু বলছেন রেলকর্তারা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৫ ০৪:১০
Share: Save:

মাতৃভূমি লোকাল থেকে পড়ে যাত্রী-মৃত্যুর ঘটনায় রেলরক্ষী বাহিনীর (আরপিএফ) মহিলা কনস্টেবলের বিরুদ্ধে খুনের মামলা শুরু করল রেল পুলিশ। কিন্তু সেই সঙ্গে সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে চললে এমনটা যে ঘটত না, সেটাও কিন্তু বলছেন রেলকর্তারা।

পূর্ব রেলের শিয়ালদহ মেন ও বনগাঁ শাখায় মাতৃভূমি লোকাল নিয়ে পরপর কয়েক দিন গোলমালের পরে গত ২১ অগস্টে রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকে স্থির হয়েছিল— মাতৃভূমি লোকালে শুধু মহিলারাই চড়বেন। পূর্ব রেল সেই সিদ্ধান্ত যথাযথ ভাবে কার্যকর করেনি বলে অভিযোগ। ওই নির্দেশের পরেও পূর্ব রেলের কর্তারা হাওড়া শাখার মাতৃভূমি লোকালগুলিতে পুরুষদের প্রবেশাধিকার রেখে দিয়েছেন। মাতৃভূমি লোকালগুলির ১২টি কামরার মধ্যে চারটি সাধারণ কামরা হিসেবে নির্দিষ্ট রয়েছে। সেগুলিতে পুরুষেরাও উঠতে পারেন। রেল মন্ত্রকের এক কর্তা বুধবার বলেন, ‘‘শিয়ালদহ শাখার মতো যদি হাওড়াতেও মাতৃভূমি লোকালে পুরুষদের ওঠা নিষিদ্ধ করা যেত, তা হলে দিপু শর্মা (৩৬) নামে ওই যুবকটি ওই ট্রেনে উঠতেই পারতেন না। এমন ঘটনাও ঘটত না।’’ কেন হাওড়ায় মাতৃভূমিতে সাধারণ কামরা থাকছে, তা নিয়ে রেল-বোর্ড তদন্তে নামতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছে মন্ত্রক।

রেল বা রেল পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা এ দিন শোনা গিয়েছে নিত্যযাত্রী মহিলাদের মুখেও। কেউ বলেছেন, ‘‘মাতৃভূমি লোকাল ব্যাপারটাই তুলে দেওয়া উচিত।’’ আবার কারও বক্তব্য, ‘‘নিয়ম ভেঙে যদি কেউ মহিলা কামরায় উঠে থাকেন, তাঁকে গ্রেফতার করলেই তো ব্যাপারটা মিটে যেত!’’

পড়ুন: কী ‘ইনটেনশন’ তোর, বলেই ধাক্কা মারল মহিলা কনস্টেবল

প্রত্যক্ষদর্শী এবং রেল পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, দিপু শর্মা হাওড়া থেকে উঠেছিলেন মাতৃভূমি লোকালের সাধারণ কামরাতেই। কিন্তু অত্যধিক ভিড় থাকায় নেমে পড়েন উত্তরপাড়া স্টেশনে। কামরা বদলাতে যান। তার আগেই ট্রেন ছেড়ে দেয়। ট্রেন ধরতে মরিয়া দিপুবাবু তখন মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট কামরায় উঠে পড়েন। উঠতেই রজনীগন্ধা নস্কর নামে এক মহিলা কনস্টেবল তাঁকে নেমে যেতে বলেন। ট্রেন গতি বাড়ানোয় দীপু বলেছিলেন, ‘‘পরের স্টেশনে নেমে যাব।’’ অভিযোগ, ওই মহিলা কনস্টেবল তা মানতে চাননি। যাত্রীদের দাবি, সে সময় তিনি দীপুকে কয়েক বার ধাক্কাও মারেন। দীপু পড়ে যান।

মঙ্গলবার ওই কামরায় থাকা কোন্নগরের নবগ্রামের বাসিন্দা বিদিশা চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘উত্তরপাড়া ছাড়ার মুখে ভদ্রলোক উঠলেন আমাদের কামরায়। কামরার মহিলা আরপিএফ কর্মী ওঁকে নেমে যেতে বলেন। লোকটি বললেন, ‘ম্যাডাম, ভুল করে উঠে পড়েছি। পরের স্টেশনে নেমে যাব।’ কিন্তু হিন্দমোটরে ট্রেন ঢোকার আগে আচমকাই ওই কনস্টেবল ধাক্কা মারলেন লোকটিকে।’’ হিন্দমোটরের বাসিন্দা রিমিতা দাশগুপ্তের বয়ানও এক— ‘‘ওই যুবক কামরায় উঠতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠেন মহিলা কনস্টেবল। যুবকটি বিনীত ভাবে নেমে যাওয়ার কথা বললেও এর পরে যা ঘটল, তা আমার কাছে দুঃস্বপ্নেরও বেশি।’’

ঘটনার পরে কনস্টেবল রজনীগন্ধার উপরে চড়াও হন বেশ কিছু মহিলাযাত্রী। গুরুতর আহত অবস্থায় রজনীগন্ধাকে বি আর সিংহ হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, কথা বলার মতো অবস্থায় নেই তিনি। পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার আর কে গুপ্ত এ দিন তাঁকে দেখতে যান। কিন্তু তাঁকেও কথা না বলেই ফিরে যেতে হয়। রেল সূত্রের খবর, মঙ্গলবার দীপুর মৃত্যুর পরে জনতার হামলায় আহত হন আরও তিন মহিলা এবং এক পুরুষ কনস্টেবল। পুরুষ কনস্টেবলের চিকিৎসা চলছে হাওড়া অর্থোপেডিক হাসপাতালে। আহত অন্য তিন মহিলা কনস্টেবলকে লিলুয়া রেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। আরপিএফ কর্মীদের কাজে বাধাদান, মারধর, রেলের সম্পত্তি নষ্ট এবং রেল অবরোধের অভিযোগে অজ্ঞাতপরিচয়দের বিরুদ্ধে দু’টি পাল্টা মামলা দায়ের করেছে আরপিএফ-ও।

এ দিন সকালে হাওড়ামুখী মাতৃভূমির যাত্রী শ্যামলী রায়, প্রণতি সরকারেরা বলছেন, ‘‘মাতৃভূমি ট্রেনটাই তুলে দেওয়া উচিত। যে কোনও ট্রেনেই তো আমরা যাতায়াত করতে পারি। ট্রেনটা ছিল বলেই একটা প্রাণ এ ভাবে চলে গেল!’’ আবার শিপ্রা দত্ত, কাকলি সাহারা বললেন, ‘‘কোনও পুরুষ যদি এই ট্রেনে উঠে পড়েন, তবে আইন মোতাবেক তাঁর সাজা হোক। কিন্তু মঙ্গলবারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়।’’ শিয়ালদহ মেন শাখার নিত্যযাত্রী পূরবী সেনগুপ্ত অবশ্য পুরো ঘটনার জন্য রেলকেই দায়ী করেছেন। তাঁর অভিযোগ, ‘‘রেল তো বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সব শাখাতেই মাতৃভূমি লোকালে সাধারণ বগি তুলে দিতে বলেছে। আমাদের শাখায় এখন মাতৃভূমিতে সাধারণ বগি নেই।’’

পড়ুন: কী করে সামাল দেবেন, কেঁদেই যাচ্ছেন দিপুর স্ত্রী

দক্ষিণ-পূর্ব রেলে একজোড়া মাতৃভূমি লোকাল চলে। ওই ট্রেনের নিত্যযাত্রী মহিলাদের একটা বড় অংশের দুশ্চিন্তা, ‘‘মঙ্গলবার যেটা হিন্দমোটরে ঘটেছে, তা যে কোনও দিন আমাদের শাখাতেও ঘটতে পারে। কারণ, আমাদের এখানেও তো ১২ কামরার ট্রেনে চারটি বগি সাধারণের জন্য। অনেক সময়েই সেই কামরায় উঠতে না পেরে পুরুষ যাত্রীরা মহিলা কামরায় উঠে পড়েন।’’

রেল মন্ত্রকের কর্তারাও ঠিক এই জায়গাটি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। এক কর্তা বলেন, ‘‘মাতৃভূমি লোকাল শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য। ২১ অগস্ট রেলমন্ত্রীর ঘোষণার পরে শিয়ালদহ শাখায় মাতৃভূমি লোকালে সাধারণ বগি তুলে দেওয়া হয়েছে। ব্যতিক্রম হাওড়া শাখা।’’ রেল কর্তাদের একাংশ এখন বলছেন, ঘটনায় দায় পূর্ব রেলের কর্তাদের উপরেই বর্তাবে। যদিও এত বড় ঘটনার পরেও পূর্ব রেলের কর্তারা সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দেননি। নীরব দক্ষিণ-পূর্ব রেলও। তবে ঘনিষ্ঠ মহলে কর্তাদের কেউ কেউ মঙ্গলবার রাতের ঘটনাটিকে নিছকই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করেছেন।

মঙ্গলবার হাওড়া স্টেশনে ভিড়ের চাপে এক বৃদ্ধের মৃত্যুর দায়ও পূর্ব রেলের কর্তাদের উপরেই চাপান নিত্যযাত্রীরা। তাঁরা বলছেন, মঙ্গলবার হিন্দমোটরের ঘটনা ঘটেছে রাত ৮টা নাগাদ। কিন্তু তার রেশ চলেছে পরবর্তী চার ঘণ্টা। ওই সময় কোনও ঘোষণাও করা হয়নি হাওড়া থেকে শুরু করে মেন লাইনের কোনও স্টেশনে। ফলে, এক সময়ে হাজার হাজার যাত্রীর ভিড় জমে গিয়েছিল হাওড়া স্টেশনে। যাত্রীদের অভিযোগ, কার্যত ওই ভিড়েই দিশাহারা হয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হন বৃদ্ধ জঙ্গবাহাদুর যাদব। তখনও রেল-কর্মীদের ডেকে পাওয়া যায়নি। মেলেনি স্টেশনের চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য কর্মীদের।

বুধবার রাতে পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র শুধু বলেন, রেল পুলিশের পাশাপাশি আরপিএফও ঘটনার তদন্ত করছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE