Advertisement
২৪ মার্চ ২০২৩

নেতাদের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা নেই চরবাসীর

চৈত্রের চড়া রোদে চারপাশ যেন আগুন হয়ে রয়েছে। রঘুনাথগঞ্জের বহুরা ঘাটে এসে দাঁড়াল গোটা দশেক মোটরবাইক। হ্যান্ডেলে বাঁধা রয়েছে দলীয় পতাকা। গন্তব্য চর পিরোজপুর ও চর বাজিতপুর। সামনে দিয়ে বয়ে গিয়েছে পদ্মা। জল এখন অনেক কম। নৌকায় ওঠার আগে থমকে দাঁড়ালেন জঙ্গিপুরের সিপিএম প্রার্থী মুজাফ্ফর হোসেন, “কিরে, সকলে ভোটার কার্ড নিয়ে এসেছিস তো?” জবাব এল সমস্বরে, “কি যে বলেন দাদা, বর্ডারে যাচ্ছি আর কার্ড নেব না?” সেই ভরদুপুরে পদ্মা পেরিয়ে তপ্ত বালি উড়িয়ে সশব্দে ছুটে চলল বাইকের সারি।

বালির চর দিয়ে এই ভাবেই যাতায়াত। —নিজস্ব চিত্র।

বালির চর দিয়ে এই ভাবেই যাতায়াত। —নিজস্ব চিত্র।

বিমান হাজরা
রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৪ ০১:২৩
Share: Save:

চৈত্রের চড়া রোদে চারপাশ যেন আগুন হয়ে রয়েছে। রঘুনাথগঞ্জের বহুরা ঘাটে এসে দাঁড়াল গোটা দশেক মোটরবাইক। হ্যান্ডেলে বাঁধা রয়েছে দলীয় পতাকা। গন্তব্য চর পিরোজপুর ও চর বাজিতপুর। সামনে দিয়ে বয়ে গিয়েছে পদ্মা। জল এখন অনেক কম। নৌকায় ওঠার আগে থমকে দাঁড়ালেন জঙ্গিপুরের সিপিএম প্রার্থী মুজাফ্ফর হোসেন, “কিরে, সকলে ভোটার কার্ড নিয়ে এসেছিস তো?” জবাব এল সমস্বরে, “কি যে বলেন দাদা, বর্ডারে যাচ্ছি আর কার্ড নেব না?” সেই ভরদুপুরে পদ্মা পেরিয়ে তপ্ত বালি উড়িয়ে সশব্দে ছুটে চলল বাইকের সারি।

Advertisement

সীমান্তঘেঁষা চরের দুই গ্রাম পিরোজপুর ও বাজিতপুর। বিদ্যুৎ নেই, সড়ক নেই, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, নেই হাইস্কুলও। জঙ্গিপুরের ওই ‘নেই’ রাজ্যে মঙ্গলবার ভোটের প্রচারে গিয়ে গ্রামবাসীদের ক্ষোভের কথা শুনলেন সিপিএম প্রার্থী মুজাফ্ফর হোসেন। এক সপ্তাহ আগে কংগ্রেসের অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ও চরে এসে স্বচক্ষে দেখে গিয়েছেন এলাকাবাসীর দুরবস্থা। আশ্বাস দিয়েছেন, চরের হাল ফেরানোর। বিজেপি কিংবা তৃণমূল এখনও সেখানে প্রচারে যায়নি। কিন্তু প্রচারে যে দলই আসুক আর যাই বলুক, চরের বাসিন্দাদের এখন আর কিছু আসে যায় না। পিরোজপুরের সুলেমান শেখ বলছেন, “গ্রামে নেতাদের আসা যাওয়া শুরু হলেই আমরা বুঝতে পারি সামনে ভোট। প্রতিবারের মতো এবারও কত প্রতিশ্রুতি শুনব। তারপর ভুলেও যাব। আবার শুনব। এভাবেই তো চলছে এতদিন।”

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ওই দুই চরে প্রায় হাজার দেড়েক পরিবারের বাস। লোকসংখ্যা ন’হাজারেরও বেশি। ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। ঘর বলতে বেশিরভাগই ইটের দেওয়ালে টালি বা টিনের ছাদ। পেশায় প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী। মেয়েদের মধ্যে বিড়ি বাঁধার রেওয়াজ রয়েছে বাড়ি-বাড়ি। কি পঞ্চায়েত, কি বিধানসভা, কি লোকসভাদুই গ্রামের ৪টি বুথে ভোটদানের হার সব সময়ই ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ। অথচ দুই গ্রামের উন্নয়নে নজর নেই জনপ্রতিনিধিদের। না ত্রিস্তর পঞ্চায়েত থেকে ঠিক ভাবে কাজ হয়েছে, না প্রশাসন থেকে নজরদারি হয়েছে।

গ্রামের বাসিন্দা ৬২ বছরের জুলু মণ্ডল জানান, আগে প্রাথমিক স্কুলও ছিল না গ্রামে। এখন প্রাথমিক স্কুল হলেও বর্ষার সময় চারিদিকে জলে ঘেরা দ্বীপের মতো গ্রামে ৬ মাস বন্ধ থাকে। অধিকাংশ ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ইতি চতুর্থ শ্রেণিতেই। উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও তা সপ্তাহে মাত্র একদিন খোলে, শিশুদের টিকা দিতে। চিকিৎসার জন্য তাই বালির চর পেরিয়ে মাইল পনেরো যেতে হয় জঙ্গিপুরে। জুলুর কথায়, “আসতে-যেতেই দিন কাবার।”

Advertisement

গ্রামেরই বাসিন্দা গোলাব হোসেনের বয়স ৬৬ পেরিয়েছে। তিনি বলছেন, “২০০৫ সালে গ্রামে এসেছিলেন জেলাশাসক ও সভাধিপতি। গ্রাম ঝেঁটিয়ে মানুষ গিয়েছিল সেই সভায়। জেলাশাসক মঞ্জুনাথ প্রসাদ সেদিন ঘোষণা করেছিলেন, গ্রামে সৌরবিদ্যুৎ আসবে। বলেছিলেন, একশো দিনের কাজের প্রকল্পে রাস্তা করে দেওয়া হবে। তারপর কত ভোটই তো দেখলাম। কিছুই হল না।”

সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ইয়াসমিন খাতুন বলে, “এখান থেকে বালির উপর দিয়ে ৫ মাইল হেঁটে আমরা প্রায় একশো ছেলে-মেয়ে হাই স্কুলে পড়তে যাই।” অসুখ-বিসুখেও গাড়ি পাওয়া যায় না। বিএসএফ মাঝে-মধ্যে গাড়িতে পৌঁছে দেয় পদ্মার পাড়ে। প্রসূতিদের পৌঁছে দেয় হাসপাতালে। ভরসা বলতে ওই টুকুই।

স্বাধীনতার এত বছর পরেও ন্যূনতম পরিকাঠামোটুকু কেন গড়ে উঠল না গ্রামে?

রঘুনাথগঞ্জ ২ ব্লকের বড়শিমুল গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রধান কাইজার হোসেন বলেন, “বিদ্যুৎ আনার দায়িত্ব নেই আমাদের। স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ার ক্ষমতাও পঞ্চায়েতের নেই। এগুলো নিয়ে বার বার পঞ্চায়েত থেকে লিখে পাঠানো হয়েছে রাজ্য সরকারের কাছে। রাজ্য, কেন্দ্র কেউই কিছু করেনি।” কিন্তু পঞ্চায়েতও কি তার কাজ করেছে? “একশো দিনের প্রকল্পে রাস্তা বানানোর কথা শুনছি কবে থেকে। কেন যে সেই কাজ হচ্ছে না, তা উপরওয়ালাই জানেন”--ক্ষোভ ঝরে পড়ে এক গ্রামবাসীর গলায়। কংগ্রেসের রঘুনাথগঞ্জের বিধায়ক আখরুজ্জামান বলেন, “চরের ওই দুই গ্রামে বিদ্যুৎ নিয়ে যেতে আমাদের সাংসদ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কি বাম, কি তৃণমূল কেউ উদ্যোগী হয়নি।” আবার তৃণমূলের রাজ্য কমিটির সদস্য শেখ ফুরকান অনুন্নয়নের দায় চাপাচ্ছেন কেন্দ্রের কাঁধে।

জীর্ণ, মলিন ভোটার কার্ডটা বুক পকেট থেকে বের করে চরের এক বাসিন্দা বলছেন, “ভোটবাবুদের কার্ডগুলো দেখুন—কেমন চকচক করছে। ওদের কার্ড লাগে ভোটের সময় কিংবা কালেভদ্রে এদিকে এলে। আর আমাদের এই কার্ড ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না। ভোট, প্রতিশ্রুতির থেকেও এই ভোটার কার্ড আমাদের কাছে অনেক বেশি জরুরি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.