Advertisement
২৫ মার্চ ২০২৩
হুমকি তৃণমূলের

কেন্দ্রীয় বাহিনী চলে যাবে, থাকব কিন্তু আমরাই

বুথে জনা চারেক আধা-সেনা একে-৪৭ ঝুলিয়ে পাহারায়। তাঁদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনও অশান্তি নেই। কিন্তু ২০০-৩০০ মিটার দূরে মোড়ে-মোড়ে জমে ওঠা ভিড়টা কেমন যেন! বুথমুখী ভোটারদের অনেককে দেখেই ভিড় থেকে কয়েকজন এগিয়ে আসছেন। ঘিরে ফেলছেন। দু’-চার কথার পরে ভোটারদের আর বুথের দিকে যেতে দেখা যাচ্ছে না। হচ্ছেটা কী?

বিতান ভট্টাচার্য ও সৌমিত্র সিকদার
গয়েশপুর ও কল্যাণী শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩৬
Share: Save:

বুথে জনা চারেক আধা-সেনা একে-৪৭ ঝুলিয়ে পাহারায়। তাঁদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনও অশান্তি নেই। কিন্তু ২০০-৩০০ মিটার দূরে মোড়ে-মোড়ে জমে ওঠা ভিড়টা কেমন যেন! বুথমুখী ভোটারদের অনেককে দেখেই ভিড় থেকে কয়েকজন এগিয়ে আসছেন। ঘিরে ফেলছেন। দু’-চার কথার পরে ভোটারদের আর বুথের দিকে যেতে দেখা যাচ্ছে না। হচ্ছেটা কী?

Advertisement

বিরোধীদের অভিযোগ, শুক্রবার বনগাঁ লোকসভার অর্ন্তগত কল্যাণী বিধানসভার গয়েশপুরে এ ভাবেই ‘নীরব সন্ত্রাস’ চালিয়েছে শাসক দল। আপাত-নিরীহ জটলা থেকে ভোটারদের একটা বড় অংশকে হুমকি দেওয়া হয়েছে“কেন্দ্রীয় বাহিনী কত দিন? এলাকায় কিন্তু আমরাই থাকব।”

শেষ কবে নির্ঝঞ্ঝাটে নিজের ভোট দিয়েছেন জানতে চাওয়া হলে জবাব দিতে পারেন না গয়েশপুরের অনেকে। দিন কয়েক আগে নির্বাচনী প্রচারে এলাকায় যাওয়া বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহকে ঘিরে ধরে তাই তাঁরা আর্জি জানিয়েছিলেন, “উপ-নির্বাচনে মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে, সে ব্যবস্থা করুন।” সিদ্ধার্থনাথও অভয় দিয়েছিলেন, “এ বার প্রচুর আধা-সেনা থাকবে। ভোট দিতে কেউ বাধা দিতে পারবে না।”

কিন্তু বাস্তব তেমন হয়নি। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই গোলমাল শুরু হয়। নববিধানপল্লিতে বিজেপি-র পাঁচ নেতা-কর্মীকে মারধর, বাড়িবাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়া এবং বিভিন্ন এলাকায় বোমাবাজির অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এ দিনও দেখা গেল, গয়েশপুর আছে গয়েশপুরেই!

Advertisement

গয়েশপুর গোলবাজারের কাছে পাবলিক লাইব্রেরিতে ২৩৭ ও ২৩৮ নম্বর বুথ। লাইব্রেরির বাঁ দিকে দু’শো মিটার দূরে চেকপোস্ট-গোকুলপুর রাস্তার উপরে সাতের মোড়। একই রাস্তায় লাইব্রেরি থেকে তিনশো মিটার দূরে আট বাই পাঁচের মোড়। বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ দুই মোড়েই অন্তত শ’দু’য়েক লোকের জমায়েত।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ভিড়ে যাঁরা রয়েছেন, শাসক দলের মিটিং-মিছিলে তাঁরা পরিচিত মুখ। ভোটকেন্দ্রে আসার পথে প্রধান দু’টি মোড়ে সকাল থেকেই চলছে ওই জটলা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, নিছক আড্ডা চলছে। কাছে যেতে দেখা গেল, বুথমুখী ভোটারদের মধ্যে কয়েকজনকে আলাদা করে কাছে ডেকে হাসিমুখে কথা বলছেন ওই জটলায় থাকা চেহারারা। সেখানে আটকে পড়া এক প্রৌঢ় হনহন করে হাঁটা দিলেন উল্টো পথে। কী হল?

নাম, এমনকী, কোন এলাকার বাসিন্দা তা প্রকাশ না করার শর্তে প্রৌঢ় জানালেন, প্রথমে তাঁকে বলা হয়, ‘কাকু আপনাকে আজকাল রাস্তায় দেখি না, খবর ভাল তো?’ চমক এর পরেই। প্রৌঢ়ের কথায়, “ভিড়ের মধ্যে কানের কাছে কেউ বলল, ‘বাহিনী আজ আছে, কাল চলে যাবে। এলাকায় কিন্তু আমরাই থাকব। বাড়িতে থাকুন, টিভি দেখুন। বুথে যাওয়ার দরকার কী!’ এর পরে বুথে যাই কী করে!”

জটলার দিকে পা বাড়াতেই ভিড়টা ছড়িয়ে গেল। ভোটারদের অনেককে জটলা পর্যন্ত এসে ফিরে যেতে দেখা যাচ্ছে কেন? মধ্য তিরিশের কিছু যুবক জবাব দিলেল, “অনেকেই ভোটার-কার্ড বাড়িতে ফেলে এসেছেন। সেটাই আনতে গেলেন। এখনই আসবেন।” দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও কিন্তু ফেরত যাওয়া মুখগুলোকে বুথের দিকে যেতে দেখা যায়নি। কাঁটাগঞ্জ, বকুলতলা, বেদীভবন এলাকাতেও এ ধরনের একাধিক জটলা চোখে পড়েছে।

কল্যাণী এবং গয়েশপুর নিয়ে শাসক দলের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগের তালিকা খুব ছোট নয়। যেমননবারুণ সঙ্ঘের মোড়ের বুথে সিপিএম এজেন্টদের ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদে অবরোধ করে সিপিএম। নেতাজি বালিকা বিদ্যালয়ের ২৩২ ও ২৩৩ নম্বর বুথ এবং কাঁটাগঞ্জ জিএসএফপি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৫২ ও ২৫৩ নম্বর বুথে শাসক দলের লোকেরা বাছাই করা লোক ছাড়া অন্য কাউকে লাইনে থাকতে দিচ্ছিলেন না। ভোটারদের লাইনে ফেরানোর চেষ্টা করায় সিপিএম প্রার্থী দেবেশ দাসকে হেনস্থা করা হয়েছে। দেবেশবাবুর কথায়, “মানুষ ভোট দিতে যেতে পারছেন না। রাস্তায় তাঁদের আটকে দেওয়া হচ্ছে।”

বিজেপি-র দাবি, সগুনার লিচুতলা অঞ্চলে তাদের কর্মী দুই ভাইকে এ দিন মারধর করা হয়েছে। বনগাঁ আসনে বিজেপি প্রার্থী সুব্রত ঠাকুরের কথায়, “আমাদের কর্মীদের উপরে বহু জায়গায় হামলা হয়েছে।” দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের অভিযোগ, কল্যাণী এবং গয়েশপুরে মোট ৫৫টি বুথে জনতাকে স্বাধীন ভোটদানে বাধা দিয়েছে তৃণমূল। তাঁর দাবি, “রাস্তার মোড়ে মোড়ে তৃণমূল ভোটারদের আটকেছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী যখন টহল দিয়েছে, তখন সরে গিয়েছে। বাহিনী চলে গেলেই স্বমহিমায় ফিরে এসেছে।”

বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতা ভোটারদের বিনা ঝামেলায় ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরে এই পরিস্থিতি কি অভিপ্রেত? রাহুলের বক্তব্য, “গত বিধানসভা এবং লোকসভা ভোটের অভিজ্ঞতার নিরিখে কল্যাণী এবং গয়েশপুর সম্পর্কে বিজেপি আগেই নির্বাচন কমিশনকে সচেতন করে রেখেছিল। এমনিতে ওই দুই জায়গায় কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। তবে কমিশনের তরফে কিছুটা সতর্কতা ছিল বলে গত দু’বারের তুলনায় এ বার কল্যাণী, গয়েশপুরে কম গোলমাল হয়েছে।” রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধেও শাসক দলের হামলায় মদত দেওয়ার অভিযোগ করেছেন রাহুলবাবু।

তবে নদিয়ার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, নির্দিষ্ট কারও বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ তাঁরা রাত পর্যন্ত পাননি। ফোনে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতেও পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। কল্যাণী বিধানসভা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক এ কে গাড়োয়াল বলেন, “দু’-একটি জায়গায় বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছিল। খবর পেতেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।” বিরোধীদের অভিযোগ নস্যাৎ করে বনগাঁ আসনে তৃণমূল প্রার্থী মমতা ঠাকুর দাবি করেছেন, “আমাদের বিরুদ্ধে সাজানো অভিযোগ করা হচ্ছে। ভোটারদের বাধা দেওয়া হয়নি।”

যদিও তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি গয়েশপুরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এক প্রৌঢ়ের। এলাকার এক জটলায় বাধা পেয়ে গজগজ করছিলেন, “কে বিজেপি, কে সিপিএম বাছতে গিয়ে ওরা কি না আমাকে বাড়ি চলে যেতে বলল! আরে ভোটটা তো দিদির দলকেই দিতাম!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.